বাংলাদেশের ব্যাংকিং জগতে মোবাইল ব্যাংকিং এক আশীর্বাদের নাম। মুহূর্তেই দেশের যেকোন প্রান্তে টাকা পয়সা লেনদেন করা এখন অনেক সহজ। কয়েক বছর পূর্বে যখন কাউকে টাকা পাঠাতে কিংবা তুলতে যখন ব্যাংকে গিয়ে লাইন ধরে প্রচুর সময় নস্ট করতে হতো। মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধার বদৌলতে এখন চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। টাকা পাঠানো এখন ২-১ মিনিটের ব্যাপার মাত্র। আর টাকা তুলতেও যেতে হয়না শহরের ব্যাংক শাখায়। প্রতিটি পাড়া/মহল্লাতেই বলতে গেলে এখন পাওয়া যায় মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট। ফলে দেশের আর্থিক লেনদেনে এক কথায় বিপ্লব ঘটেছে। এছাড়া টাকা দেওয়া নেওয়া ছাড়াও বিল পরিশোধ, জমানো টাকায় ইন্টারেস্ট পাওয়ার মতো বেশ কিছু সুবিধাও এখন মোবাইল ব্যাংকিং -এর মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে।

মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস

বাংলাদেশের এই ব্যাংকিং বিপ্লবে বিকাশ এবং রকেট হল অনন্য অবদান রাখা দুটি মোবাইল ব্যাংকিং ব্র্যান্ড। জনপ্রিয় মোবাইল ব্যাংকিং অপারেটর বিকাশ মূলত ব্র্যাক ব্যাংকের একটি প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে রকেট হল ডাচ বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধা প্রদানকারী একটি ব্র্যান্ড। যদিও রকেট নামকরনের পূর্বে এর নাম ছিল ডিবিবিএল মোবাইল ব্যাংকিং। বিকাশের যাত্রা শুরুর আগে থেকেই ডাচ বাংলা ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধা চালু থাকলেও তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। ২০১১ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে ডাচ বাংলা ব্যাংক। অন্যদিকে বিকাশ বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস শুরুর সাথে সাথে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয় এবং বড় একটি বাজার দখল করে ফেলে। মানুষ বিকাশের হাত ধরেই মোবাইল ব্যাংকিং এর প্রথম কার্যকারী সুবিধা পেতে শুরু করে। এরপর ডাচ বাংলা ব্যাংক তাদের মোবাইল ব্যাংকিং ব্র্যান্ডকে রকেট নামকরন করে বিকাশের সাথে প্রতিযোগিতায় নামে। বিভিন্ন বাড়তি সুযোগ সুবিধা দেয়ার ফলে বিকাশের পাশাপাশি রকেটও মানুষের আস্থা অর্জন করে নেয়। বর্তমানে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের এই দুটি বড় ব্র্যান্ড জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে মোটামুটি সমতায় আছে। তবে সম্প্রতি রকেট তাঁদের লেনদেন ফি পরিবর্তন করেছে। আর এর ফলে মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস গ্রহনকারীরা রকেট এবং বিকাশ নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দে আছেন। বিকাশ নাকি রকেট? এমন প্রশ্নের উত্তর যদি আপনিও খুঁজে থাকেন। তবে আপনার জন্যই আজকের পোস্ট। আজ একনজরে আমরা জানব গ্রাহক সেবা এবং লেনদেন ফি -এর দিক দিয়ে বিকাশ এবং রকেট কে কোন অবস্থানে আছে।

এক নজরে বিকাশ এবং রকেটের চার্জ এবং গ্রাহক সেবা

  • বিকাশ এবং রকেট দুটো প্রতিষ্ঠানেরই একাউন্ট খোলা যায় একদম বিনামূল্যে।
  • বিকাশের একাউন্টে থাকা পুরো অর্থই আপনি তুলতে পারবেন। কিন্ত রকেটে নূন্যতম ২০ টাকা আপনাকে রাখতেই হবে। এই ২০ টাকা আপনি কখনই তুলতে পারবেন না।
  • বিকাশ, রকেটে কোন ক্যাশ-ইন চার্জ নেই।
  • প্রতি এক হাজার টাকায় বিকাশ ক্যাশ আউট বা টাকা উত্তোলন চার্জ যথাক্রমেঃ এজেন্ট থেকে ১৮ টাকা ৫০ পয়সা, অ্যাপ দিয়ে ১৫ টাকা (প্রোমোশনাল অফার), এটিএম বুথ থেকে ১৫ টাকা। তবে এটিএম বুথ থেকে বিকাশের টাকা তুলতে মিনিমাম ২ হাজার টাকা ক্যাশআউট করতে হবে। অন্যদিকে রকেট থেকে আপনি এজেন্ট পয়েন্ট থেকে ক্যাশআউট করলে চার্জ কাটবে ১৮ টাকা। আর এটিএম বুথ এবং ডিবিবিএল ব্রাঞ্চ থেকে ক্যাশ আউট করলে লাগবে মাত্র ৯টাকা। যদিও এর আগে রকেট থেকে এটিএম বুথ দিয়ে টাকা উত্তোলন ফ্রি ছিল।
  • ডায়াল কোডের মাধ্যমে স্টেটমেন্ট দেখতে রকেট চার্জ কাটে ৩টাকা। অন্যদিকে বিকাশে স্টেটমেন্ট দেখা একদম ফ্রি। তবে অ্যাপের মাধ্যমে স্টেটমেন্ট দেখতে বিকাশ বা রকেট কোনটিতেই চার্জ প্রযোজ্য নয়।
  • দেশের প্রায় সব জায়গাতেই বিকাশের এজেন্ট পাওয়া যায়। কিন্ত রকেটের এজেন্ট তুলনামূলক কম। সম্প্রতি রকেট এজেন্টের সংখ্যা বাড়ালেও বেশিরভাগ গ্রাহকের অভিযোগ, রকেট এজেন্টদের কাছে ব্যালেন্স থাকেনা। অর্থাৎ এজেন্ট সুবিধার দিক দিয়ে বিকাশ কিছুটা এগিয়ে।
  • এটিএম বুথের সংখ্যায় বিবেচনা করলে রকেট নিঃসন্দেহে এগিয়ে। অন্যদিকে বিকাশ অর্থাৎ ব্র্যাক ব্যাংকের বুথের সংখ্যা হাতে গোনা। এটিএম বুথ সুবিধার জন্য রকেট বেশ জনপ্রিয় ছিল। কিন্ত এটিএম বুথেও চার্জ প্রযোজ্য করায় এর জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাঁটা পড়েছে।
  • রকেট একাউন্ট নম্বর হিসেবে আপনার মোবাইল নম্বরটি ব্যবহৃত হলেও নম্বরের শেষে একটি বাড়তি ডিজিট/নম্বর যোগ করা হয়। এর ফলে ভুল নম্বরে টাকা পাঠানোর সম্ভাবনা অনেক কম। অন্যদিকে বিকাশের একাউন্ট নম্বর হিসেবে আপনার মোবাইল নম্বরটিই শুধু বিবেচিত হয়। যার কারণে, ভুল নম্বরে টাকা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর ভুল নম্বরে টাকা যাওয়ার এরকম ঘটনা বিকাশে অহরহই ঘটছে।
  • পেমেন্ট পরিশোধের জন্য অনেক শপেই বিকাশ সুবিধা থাকে। কিন্তু রকেটের ক্ষেত্রে শপগুলোতে এরকম সুবিধা খুব কম দেখা যায়।
  • বিকাশের অ্যাপটি ইউজার ইন্টারফেসের দিক দিয়ে অনেকটা আকর্ষণীয়। কিন্ত সিকিউরিটির ব্যাপারে বিকাশ অ্যাপের বিরুদ্ধে প্রায়ই অনেক অভিযোগ শোনা যায় গ্রাহকদের কাছে। এদিক দিয়ে রকেটের অ্যাপ ইউজার ইন্টারফেসে আকর্ষণীয় না হলেও তুলনামূলক সিকিউরড। এছাড়া ডাচ বাংলা ব্যাংকের Nexus Pay নামের একটি বিশেষ অ্যাপ রয়েছে। যার মাধ্যমে আপনি আপনার রকেট ওয়ালেটকে ভার্চুয়াল মাস্টারকার্ড হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন। অর্থাৎ, নেক্সাস পে অ্যাপ আপনাকে রকেট দিয়েই ডাচ বাংলা ব্যাংকের যেকোন একাউন্ট অথবা কার্ডে টাকা পাঠানোর সুবিধা দিবে। আরও রয়েছে ইউটিলিটি বিল পেমেন্ট, অনলাইন কেনাকাটা, মোবাইল টপআপ সহ বেশ কিছু সুবিধা। এসব দিক দিয়ে বিকাশের এধরনের কোন বাড়তি সুবিধা সম্বলিত অ্যাপ নেই।
  • গ্রাহককে তাৎক্ষনিক সাপোর্ট দিতে বিকাশ রকেটের থেকে অনেক এগিয়ে। বিকাশের ওয়েবসাইটে রয়েছে ২৪ ঘন্টা লাইভ চ্যাট সাপোর্ট সুবিধা। এছাড়া ফেসবুক পেজ এবং কল সেন্টারের মাধ্যমেও বিকাশ তার গ্রাহকদের সাপোর্ট দিয়ে থাকে। এদিকে রকেটের ওয়েবসাইটে নেই কোন লাইভ চ্যাট সুবিধা, ফেসবুক পেজ এবং ইমেইল করে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে উত্তর পাওয়া যায় না বললেই চলে। শুধুমাত্র কল সেন্টারের মাধ্যমেই রকেট কাস্টমার সাপোর্ট দিয়ে থাকে।

রকেট এবং বিকাশের লিমিট (Transaction Limit)

mobile banking limit

ঘরে বসে “রকেট” একাউন্ট খোলার নিয়ম জেনে নিন

বিকাশ নাকি রকেট? কোন মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস ব্যবহার করবেন?

প্রতিযোগিতার এই বাজারে বিকাশ এবং রকেট দুটো প্রতিষ্ঠানই তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রতিনিয়তই তাঁরা গ্রাহক সেবা বাড়াতে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা যুক্ত করছে এবং কাজ করে যাচ্ছে। আজকের রিভিউ বিবেচনা করলে দেখা যাবে, একেক ফিচারের দিক দিয়ে একেক প্রতিষ্ঠান এগিয়ে। অর্থাৎ, কোন একটি সুবিধায় বিকাশ এগিয়ে থাকলেও অন্য কোন সুবিধায় বিকাশ রকেটের থেকে পিছিয়ে। আমাদের প্রত্যেকের চাহিদা ভিন্ন। বিকাশ নাকি রকেট? তাই এমন প্রশ্নের উত্তরটাও মিলবে আপনারই কাছে। অর্থাৎ, বিকাশ এবং রকেটের তুলনামূলক সুযোগ সুবিধা বিবেচনা করে যেটি আপনার চাহিদা অনুযায়ী মিলে যাবে সেটিই ব্যবহার করুন। একজন ব্যক্তি তাঁর চাহিদা বিবেচনায় বিকাশকে বেছে নিলেও অন্যজন হয়ত বেছে নিচ্ছেন রকেট -কে। তবে ব্যক্তিগতভাবে পরামর্শ থাকবে, বিকাশ এবং রকেট দুটো সার্ভিসই একসাথে ব্যবহার করুন। এর ফলে যখন যে অপারেটরটি সুবিধাজনক মনে হবে সেটির মাধ্যমেই লেনদেন করতে পারবেন। রকেট এবং বিকাশ নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা এবং মন্তব্য জানাতেও ভুলবেন না কিন্ত!

I hope you are enjoying this article. Thanks for visiting this website.