BANGLADESH

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের কারণগুলাে বর্ণনা কর

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বিশ্বের ইতিহাসে এক বড় জায়গা দখল করে আছে। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আমরা ছিলাম পরাধীন। কিন্তু আজ স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে মাথা উঁচু করে আছে। অস্রহীন বাঙালিরা কি করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পরা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাহিনীদেরকে পরাজিত করে যুদ্ধে জয় লাভ করল তার কয়েকটি কারন তুলে ধরা হলঃ

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের কারণগুলো বর্ণনা কর।

ক) ঐকবদ্ধতা : মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের প্রধান এবং মুখ্য কারন হল ঐকবদ্ধতা। কারন সকল স্তরের মানুষ যে যা পারে তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরেছিল।
খ) দেশপ্রেম ও সাহস ঃ বাংলার ধামাল ছেলেরা অস্রহীন হয়েও দেশমাতার টানে নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করে বুক ভরা সাহস আর দেশপ্রেম নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরেছিল।
গ) গেরিলা আক্রমন ঃ মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের বড় একটি কারন হল আক্রমন কৌশল এবং পরিকল্পনা। আর গেরিলা আক্রমন ছিল তার মূল অংশ।
ঘ) সামরিক কমান্ড তৈরি ঃ গেরিলা আক্রমনকে পাকাপোক্ত করার জন্য সামরিক কমান্ড তৈরি করা হয়। বাংলাদেশকে সর্বমোট ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং প্রতিটি সেক্টরের জন্যে একজন করে অধিনায়ক নির্বাচন করা হয়।
ঙ) অপারেশন জ্যাকপট ঃ অপারেশন জ্যাকপট বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নৌ-সেক্টর পরিচালিত সফলতম গেরিলা অপারেশন। এটি ছিল একটি আত্মঘাতী অপারেশন। এই অপারেশন বাংলাদেশের যুদ্ধ এবং যোদ্ধাদেরকে সারা বিশ্বে পরিচিতি পাইয়ে দেয়।
চ) স্বাধীনতার ঘোষণা : মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের এবং যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার পিছনে ২৬ শে মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা। যার নেপথ্যে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। 
 
ছ) এছাড়া ৬ দফা দাবি এবং  শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত ৭ ই মার্চের ভাষণ মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের জন্য অনুপ্রেরনা দিয়েছিল। এবং প্রবল  ধৈর্য ছিল বাঙ্গালিদের কারন টানা ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে আমরা পেয়েছে স্বাধীনতা।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। এসব কারণ একত্রে বাংলাদেশকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় এনে দেয়। নিচে প্রধান কারণগুলো বর্ণনা করা হলো:

১. বাংলাদেশের জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ

মুক্তিযুদ্ধ শুধুমাত্র সামরিক যুদ্ধ ছিল না, এটি ছিল বাঙালি জাতির সার্বিক প্রতিরোধ যুদ্ধ। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, সাধারণ জনগণ—সবার অংশগ্রহণে এ যুদ্ধ গণআন্দোলনে পরিণত হয়। এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল।

২. মুক্তিবাহিনী ও গেরিলা কৌশল

বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী সুসংগঠিত হয়ে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করে। তারা বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা চালাত এবং তাদের রসদ সরবরাহ ব্যবস্থাকে ব্যাহত করত। এ কৌশল পাকিস্তানি সেনাদের দুর্বল করে দেয়।

৩. ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তা

ভারত মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, রসদ ও কূটনৈতিক সহায়তা দেয়। ৩ ডিসেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে যুদ্ধ করে এবং ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করে।

৪. আন্তর্জাতিক সমর্থন ও পাকিস্তানের কূটনৈতিক ব্যর্থতা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বিশ্বে ব্যাপক সাড়া তোলে। ভারতের পাশাপাশি সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশকে সমর্থন দেয়। অপরদিকে, পাকিস্তান আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ব্যর্থ হয় এবং চীন ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রত্যাশিত সাহায্য দেয়নি।

৫. পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়া

মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ, খাদ্য ও রসদ সরবরাহের ঘাটতি, অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং যুদ্ধের দীর্ঘায়িত হওয়ার ফলে পাকিস্তানি সেনারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে তারা সহজেই আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

৬. মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক দক্ষতা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের অধীনে পরিচালিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক নির্দেশনা, তাজউদ্দীন আহমদের প্রশাসনিক দক্ষতা এবং মুক্তিযুদ্ধের সামরিক নেতৃত্ব বিজয়ের পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৭. পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ও দমননীতি

পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু করে এবং পুরো যুদ্ধকালজুড়ে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। এই বর্বরতা বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীর মধ্যে তীব্র ক্ষোভ তৈরি করে, যা বাঙালিদের যুদ্ধের প্রেরণা জোগায় এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন বাড়ায়।

উপসংহার

বাংলাদেশের বিজয়ের প্রধান কারণ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দৃঢ় মনোবল, সাধারণ জনগণের প্রতিরোধ, আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং ভারতীয় বাহিনীর সামরিক সহায়তা। পাকিস্তান বাহিনীর দুর্বল কৌশল ও মনোবলের অভাবও তাদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ। সব মিলিয়ে, মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির আত্মত্যাগ, নেতৃত্ব ও সংগঠনের এক অবিস্মরণীয় বিজয়গাঁথা।

About Author

I hope you are enjoying this article. Thanks for visiting this website.