ভারতীয় উপমহাদেশে তাজমহলের একটি অন্যতম মূল্য রয়েছে। ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো তাজমহল কে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে। এটা তৈরি করতে গিয়ে যেমন অনেক ইতিহাস রচনা হয়েছে। সেইসাথে এটা তৈরি করার পর ও ইতিহাসের জানা অজানা এখনো রয়ে গেছে।
তিন একর জায়গায় নির্মান করা হয় তাজমহল। তাজমহলে ভিক্তি, সমাধি, মসজিদ, প্রবেশ দরজা, জাওয়াব চারটি মিনার তৈরী করা হয়েছে। ১৬৪৩ সালে এই তাজমহলের সমাধি ও ভিক্তি নির্মান করতে প্রায় ১২ বছর সময় লেগেছে। আর সেই তাজমহলের আশেপাশের পুরো স্থান নির্মান করতে প্রায় ১০ বছর সময় লেগেছে।
আমরা তাজমহল সম্পর্কে জানতে গেলে সব চাইতে বেশি জানি যে তাজমহল শাহজাহান তার প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজের জন্য তৈরি করেছিলো। কিন্তু কে তাজমহলের স্থপতি বা কারা তৈরি করেছে অনেকেই জানি না।
আজকে এই আর্টিকেল থেকে আমরা জানবো তাজমহলের সম্পর্কে। যারা এই সুন্দর অপূর্ব সৌন্দর্যের তাজমহল তৈরি করেছিল যেসব স্থপতি তাদের সম্পর্কে।
আমরা অনেকেই জানি না তাজমহলের প্রকৃত স্থপতিদের সম্পর্কে তাদেরকে নিয়ে আমাদের এই আর্টিকেলটি। আশা করি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়লে তাজমহল সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবেন।
তাজমহলের প্রধান স্থপতি কে?
অপরূপ সৌন্দর্য প্রেম ভালবাসার তাজমহল এর এত সুন্দর নকশা একজন ব্যক্তি দ্বারা কখনো সম্ভব নয়। তাই তাজমহল এর প্রধান স্থপতি কে এটা নিয়ে অনেকের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তাজমহল এর বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন স্থপতি নির্মাণ করেছে। বিভিন্ন ইতিহাস ও উৎস থেকে তাজমহল নির্মানের যেসব অংশ যারা যারা কাজ করেছিল তা নিম্নে তুলে ধরা হলো;
ওস্তাদ ইসাঃ
পারস্য দেশের প্রতি ওস্তাদ ঈশা খাঁ পুরো তাজমহলের বিভিন্ন চত্বরের নকশা করে। তাজমহলের বিভিন্ন চাদরের নকশা করার জন্য তার ভূমিকা বিশেষভাবে পাওয়া গিয়েছে। বিভিন্ন ইতিহাস ও উৎস থেকে তাজমহলের চত্বরের নকশা পারস্য দেশের সাথে মিল পাওয়া গিয়েছে। সেই সাথে এটা জানা যায় যে পারস্য দেশের স্থপতি ওস্তাদ ইসা তাজমহলের ভিতরের নকশা করেছিলেন।
এছাড়াও পারস্য দেশ বর্তমানে তথা ইরানের এক ফারসি ভাষায় লেখা পুরো তাজমহলের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে ওস্তাদ ঈশা কে বলা হয়ে থাকে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে বেনারসের ‘পুরু’ নির্মাণ করার জন্য শুধুমাত্র পারস্য দেশের লোকেদের প্রয়োজন হয়। আর এ কারণে ওস্তাদ ইসা এই নকশা আা ডিজাইন করেছিল এটা বিভিন্ন উৎস থেকে জানা যায়।
ইসমাইল খাঁনঃ
পারস্য দেশের ওস্তাদ ইশা পুরো তাজমহলের ভিতরের নকশা করে। এরপর বিভিন্ন গম্বুজ নকশা করার জন্য সম্রাট শাহজাহান অটোমান সাম্রাজ্য থেকে ইসমাইল খান কে আনেন। ইসমাইল খান অটোমান সাম্রাজ্য থেকে এসে বড় বড় গম্বুজ গুলোর নকশা করেন। তৎকালীন সময়ে ইসমাইল খান ছিলেন সে যুগের প্রথম গম্বুজ নির্মাণ কারী আা প্রথম নকশাকারী। বিভিন্ন ইতিহাসবিদ ও উৎস থেকে জানা যায় যে তাজমহলের বিভিন্ন বড় বড় গোলার্ধের গম্ভুজ গুলোর নকশা গুলো করেছিল অটোমান সাম্রাজ্য থেকে আসা এক অসাধারণ গম্বুজ নির্মাণ কারী ইসমাইল খান।
কাজিম খাঁনঃ
আপনারা যদি তাজমহল কখনো দেখতে যান বা কখনো যে তাজমহলের ভিতরে বাহিরে দেখে থাকেন। তাহলে একটা বড় গম্বুজ এর চূড়ায় একটি দণ্ড দেখতে পাবেন। সেটা কিন্তু পুরোটাই স্বর্ণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিলো। এটা তৈরি করেছিল লাহোরের এক বাসিন্দা ও কারুকার্য শিল্পী কাজিম খাঁন। বিভিন্ন উৎস ও ইতিহাস থেকে জানা যায় যে লাহোরের (বর্তমান পাকিস্তানের অংশ) বাসিন্দা ছিল কাজিম খাঁন। তিনি তাজমহলের বড় গম্বুজ এর চূড়ায় স্বর্ণের একটি দন্ড রয়েছে সেটা তৈরি করেছিল। যেটা তৈরী করায় তাজমহলের সৌন্দর্য আরো হাজার গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল।
চিরঞ্জিব লালঃ
তৎকালীন সময়ে দিল্লির একজন বিখ্যাত পাথর খোদাই কারক ছিল চিরঞ্জিব লাল। চিরঞ্জিব লাল ছিল পুরো তাজমহলের প্রধান ভাস্কর্য মোজাইক কারক। আপনারা পুরো তাজমহলে যে সব প্রধান প্রধান ভাস্কর্য গুলো ও পাথর খোদাই করা মোজাইক গুলো দেখে থাকবেন। এগুলো পাথর খোদাই করে তৈরি করে চিরঞ্জিব লাল। এগুলো সবই তৈরি তিনি একাই দিক নির্দেশনা দিয়ে করেছিল। তৎকালীন সময়ে দিল্লির প্রধান ভাস্কর্য ও পাথর খোদাইকারক শিল্পী চিরঞ্জিত লাল কে দিয়ে পুরো তাজমহলের ভাস্কর্যের কাজ করা হয়।
আমানত খাঁনঃ
তৎকালীন সময়ের ইরানের বিখ্যাত পাথর খোদাইকারক আমানত খাঁন তাজমহলের দরজায় চারুলিপি করেছে। তার চারুলিপির খোদাই করা এখনো তাজমহলের প্রবেশ দরজায়। সেই সাথে উক্ত দরজায় আমানত খাঁন এর নাম এখনো লেখা করা আছে।
মোহাম্মদ হানিফঃ
পুরো তাজমহল তৈরিতে যেসব রাজমিস্ত্রিদের কে নিয়োগ করা হয়েছিল তাদের তত্ত্বাবধায়ক করা হয়েছিল মোহাম্মদ হানিফ কে। তিনি পুরো তাজমহল এর বিভিন্ন রাজমিস্ত্রির কাজ গুলোর দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকতো। মূলত তার কারণে তাজমহলের সৌন্দর্য আরো অনেক গুণে বৃদ্ধি পেয়েছিল বলে বিভিন্ন ইতিহাসবিদ ও উৎস থেকে জানা যায়।
মুক্কারিমাত ও মীর আব্দুল করিমঃ
এছাড়াও সুদূর পারস্য থেকে মুক্কারিমাত ও মীর আব্দুল করিম ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক কাজ গুলো করত। যখন যা প্রয়োজন হলো যখন যেখানে খরচ করা হত এসবইর দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলো মীর আব্দুল করিম ও মুক্কারীমাত খাঁন।
তাজমহল সম্পর্কে অজানা কিছু ইতিহাস
তাজমহল এমন একটি নির্দেশনা যেটা ভালোবাসাই নয় শুধুমাত্র এর কিছু কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো শুনলে আপনার বিশ্বাস হবে না। কেননা তাজমহল তৈরি করতে প্রয়োজন হয়েছে প্রায় ২৮ ধরনের বেশি রত্ন পাথর। নিচে আমরা তাজমহলের কিছু জানা অজানা বিষয় তুলা ধরা হলো;
১/ তাজমহল তৈরি করতে প্রায় এক হাজারেরও বেশি হাতীর প্রয়োজন হয়ে ছিল। যে হাতী গুলো দিয়ে তাজমহল নির্মানের বিভিন্ন মালামাল আনা নেওয়া করা হতো।
২/ তাজমহল তৈরি করার জন্য চীন থেকে সাদা ও সবুজ পাথর এবং স্ফটিক টুকরো পাথর আনা হয়েছিল।
৩/ আরব থেকে তাজমহল তৈরি করার জন্য আনা হয় রক্তিমাভাব সাদা রঙের মূল্যবান পাথর।
৪/ তাজমহল তৈরি করার জন্য আফগানিস্তান থেকে আনা হয়েছিল নীলকান্তমণি।
৫/ তাজমহল তৈরি করার জন্য শ্রীলঙ্কা থেকে আনা হয়েছিল নীলমণি নামে এক ধরনের উজ্জ্বল রত্ন।
৬/ তাজমহল তৈরি করার জন্য তীব্বত থেকে আনা হয়েছিল সবুজ গিলাপ। যেটাকে আমরা ফিরোজা রং বলে থেকেই রঙের রত্ন।
৭/ এছাড়া আরও বিভিন্ন ধরনের মহা মূল্যবান পাথর দিয়ে তাজমহল তৈরি করা হয়েছিল।
৮/ ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ব্রিটিশ আমলে তাজমহলের অনেক পাথর বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বাটালী দিয়ে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল।
এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে তাজমহলে উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গিয়েছিল। যে সবের কারণে তাজমহলের ক্ষতির আরো অনেক পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তবুও ভালোবাসার তাজমহল দমে যায়নি। দমে যায়নি শাহজাহান মমতাজের ভালোবাসা। এখনো তাজমহল শাহজাহান মমতাজের ভালোবাসা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
তাজমহল দেখতে বিশ্ব থেকে প্রতিবছর লাখ লাখ লোক তাজমহল আগ্রায় ভ্রমণ করতে আসে। যদি কখনো তাজমহল দেখতে চান তাহলে চলে যেতে পারেন ভারতের যমুনা নদীর তীরের আগ্রায়। যেখানে তৈরি করা হয়েছে মমতাজের জন্য শাহজাহানের তৈরি করার তাজমহল।
আশা করি তাজমহল সম্পর্কে আপনার এখনো অনেক কিছু জানতে পেরেছেন। এছাড়াও আমরা আপনাদের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করেছি তাজমহল তৈরি করেছিল কোন স্থপতি বা কাদের দ্বারা তাজমহল তৈরি করেছিল তাদের সম্পর্কে।
তাজমহল কিন্তু এমন একটি বিষয় নয় যে, যেটা একজন ব্যক্তি দ্বারা তৈরি করা হয়েছে। তাই তাজমহল তৈরি করার জন্য বিভিন্ন ধরনের স্থপতি ব্যক্তিবর্গের প্রয়োজন পড়েছে।
তাজমহলের ভিতরে কেউ কেউ তাজমহলের গম্বুজের নকশা করেছে, ঠিক তেমনি ভাবে কেউ কেউ আবার কারুকার্যখচিত বিভিন্ন পাথরের নকশা করেছে, আবার কেউ কেউ আর্থিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলো। আবার কেউ কেউ বিভিন্ন ধরনের নকশা করেছে।
আলাদা আলাদা নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা স্থপতি তাজমহল তৈরি করেছিল। বিভিন্ন স্থপতি দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল অপরূপ সৌন্দর্যের এই তাজমহল। যেটা পুরো বিশ্বে এখনো সৌন্দর্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
আশাকরি তাজমহল এর অজানা বিষয় ও তাজমহলের স্থপতি সম্পর্কে আপনি এখন সবকিছু ভালো ভাবে জানতে এবং বুঝতে পারলেন। এরপর যদি আপনি কোন কিছু জানতে বা বুঝতে না পারেন তাহলে অবশ্যই আমাদের কে কমেন্টে বক্সে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আমরা যেন আপনার সমস্যার সমাধান করে দিতে পারি। তাহলে দেখা হবে নতুন কোন আর্টিকেলে নতুন কোন বিষয় নিয়ে। ততক্ষণ পর্যন্ত আশা করি সবাই ভাল থাকবেন সুস্থ থাকবেন।