মুসলমানদের জন্য রমজান বছরের পবিত্রতম মাস। প্রাপ্তবয়স্ক সকল মুসলিম নর-নারীর উপর সিয়াম সাধনা ফরজ করা হয়েছে এ মাসে। যেহেতু রোজা আমাদের ওপর ফরজ, তাই রোজা পালনে আমাদের সতর্ক হওয়া জরুরী। যেসব কারণে রোজা ভেঙ্গে যেতে পারে, সে কারণগুলো জানা থাকলে এ বিষয়ে সচেতন হওয়া এবং তা এড়িয়ে সঠিক ভাবে রোজা রাখা আমাদের জন্য সহজ হবে।
তাই, রোজা ভেঙ্গে যাওয়ার সকল কারণ নিয়ে নীচে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে, লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়া আপনার সিয়াম সাধনার জন্য উপকারী হবে বলে নিশ্চিত করে বলা যায়।
রোজা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণসমূহ
আল্লাহ তা’আলা রোজার বিধান যেমন জারী করেছেন, তেমনি রোজা বিনষ্ট করতে পারে এমন বিষয়ও আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। রোজা বিনষ্টকারী বিষয়ের ওপর ভিত্তি করেই আমরা রোজা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণসমূহকে দুটো সাধারণ ভাগে ভাগ করে ফেলতে পারি,
রোজা বিনষ্টকারী কোন উপাদান শরীর থেকে নির্গত হলে রোজা ভেঙ্গে যায়, যেমন, সহবাস, ইচ্ছাকৃত বমি করা, হায়েয ও শিঙ্গা লাগানো।
আবার রোজা বিনষ্টকারী কিছু উপাদান রয়েছে যা শরীরে প্রবেশ করলে রোজা ভেঙ্গে যায়, যেমন, পানাহার। ভিত্তিগত দিক থেকে চিন্তা করলে রোজা ভাঙ্গার সকল কারণকে শুধু এই দুইটি দিক থেকেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
আরও জানুনঃ তারাবি নামাজ নিয়ে বিস্তারিত প্রশ্ন ও উত্তর
রোজা ভঙ্গের কারণ কয়টি ও কী কী?
রমজান মাসে যেমন রোজা রাখা ফরজ, তেমনি অনেকেই বছরের অন্যান্য দিনেও বিভিন্ন সুন্নত, নফল রোজাও রাখেন। রোজা ভঙ্গের কারণগুলো জানা থাকলে এবং সে বিষয়ে সচেতন থাকলে ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়।
রোজা ভঙ্গের কারণ সাতটি। চলুন দেখে নেয়া যাক কী কী কারণে রোজা ভেঙ্গে যেতে পারে,
- পানাহারঃ রোজা রাখা অবস্থায় যে কোন রকম খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ রোজা ভঙ্গের কারণ হবে৷ এমনকি ধূমপানও পানাহারের আওতাভুক্ত অর্থাৎ রোজা ভঙ্গের কারণ।
- ওযু বা গোসলে অসতর্ক হলেঃ ওযু বা গোসলে কুলি করার সময় অসতর্কতাবশত গলার ভেতরে পানি চলে গেলে রোজা ভেঙ্গে যাবে৷
- স্ত্রীর সহিত সহবাস করলেঃ রোজারত অবস্থায় স্ত্রীর সহিত সহবাসে মিলিত হলে রোজা ভেঙ্গে যাবে৷
- বমি করলেঃ ইচ্ছাকৃত বমি করলে রোজা ভেঙ্গে যায়। তবে অনিচ্ছাকৃত বমি হলে রোজা ভাঙ্গে না, সেক্ষেত্র দ্রুত কুলি করে পুরো মুখ পরিষ্কার করে নিতে হবে৷
- হস্তমৈথুন করলেঃ রোজা থাকাকালীন হস্তমৈথুন বা অন্য কোন উপায়ে যদি কেউ ইচ্ছাকৃত বীর্যপাত ঘটায় তাহলে তা অবশ্যই রোজা ভঙ্গের কারণ হবে।
হস্তমৈথুনের কারণে রোজা ভাঙ্গলে তওবা করে পরবর্তীতে কা’যা রোজা রাখতে হবে, আর সহবাসের দরুন রোজা ভঙ্গ হলে কা’যার পাশাপাশি কাফফারাও দিতে হবে। (আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৫০; আততাজনীস ওয়াল মাযীদ ২/৩৭৭; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৫)
- ঋতুস্রাবঃ রোজারত অবস্থায় যদি কোন মহিলার মাসিক বা পিরিয়ডের রক্ত দেখা দেয়, তবে রোজা ভেঙ্গে যাবে। একইভাবে প্রসবজনিত ব্যথা শুরু হওয়ার পরও রোজা ভেঙ্গে যায়।
- শক্তিবর্ধক ইঞ্জেকশনঃ শরীরের জীবনীশক্তি বৃদ্ধি করে এমন যে কোন ইঞ্জেকশন শক্তি বৃদ্ধি বা অন্য যে কোন কারণে শরীরে প্রবেশ করালে রোজা ভেঙ্গে যায়। তবে চিকিৎসাজনিত কারণে হলে ব্যতিক্রম হতে পারে৷
রোজার নিয়ত, সেহরির দোয়া এবং ইফতারের দোয়া আরবি-বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ দেখুন
মেয়েদের রোজা ভঙ্গের কারণ
রোজা ভঙ্গের কারণগুলোর প্রায় সবই নারী পুরুষ সকলের জন্যই সার্বজনীন। তবে মেয়েদের জন্য বিশেষ কারণ হচ্ছে হায়েজ/নিফাজ/মাসিক/পিরিয়ড। মাসিক চলাকালীন মেয়েদের ওপর রোজা আর ফরজ থাকে না বরং নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এমনকি রোজা রাখা অবস্থায়ও যদি মাসিকের রক্তস্রাব শুরু হয়ে যায়, তাহলে রোজা ভেঙ্গে যায়। একইভাবে প্রসবকালীন সময়েও রোজা ভেঙ্গে যায়।
এসব রোজা পরবর্তীতে সুস্থ হলে কাজা রোজা হিসেবে পালন করার নিয়ম রয়েছে।
স্বপ্নদোষ হলে কি রোজা ভেঙ্গে যায়?
স্বপ্নদোষ হলে রোজা ভেঙ্গে যায় না। তবে সেহরি ও রোজার নিয়তের পূর্বে স্বপ্নদোষ হলে অবশ্যই ফরজ গোসল সেরে সেহরি ও রোজার নিয়ত করতে হবে।
ইচ্ছাকৃত বীর্যপাত অর্থাৎ হস্তমৈথুন কিংবা সহবাসের মাধ্যমে বীর্যপাত হলে অবশ্যই রোজা ভেঙ্গে যাবে।
রক্ত বের হলে কি রোজা ভাঙ্গে?
রোজাদার ব্যক্তির শরীর থেকে রক্ত বের হলে রোজা ভাঙ্গে না। একইভাবে সিরিঞ্জ বা অন্য কোন মাধ্যমে রক্ত বের করে নিলেও রোজা ভাঙ্গে না। তাই রোজা রেখে রক্তদানেও বাঁধা নেই।
তবে বিশেষ কারণ ব্যতীত শরীর থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে একটি বিশেষ পরিমাণ রক্ত বের করা মাকরূহ, যতটা রক্ত বের করার কারণে ওই দিন রোজা পূর্ণ করার শক্তি হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা হয়। (সহিহ বোখারি, হাদিস ১৯৩৮, ১৯৪০; ফিকহুন নাওয়াযিল- ২/৩০০)
রোজা রেখে থুথু খাওয়া যাবে কি?
রোজা রেখে থুথু খেয়ে ফেললে কিংবা গিলে ফেললে রোজা ভাঙ্গে না। নিজ মুখের থুথু জমা না করে গিলে ফেললে রোজার কোনো ক্ষতি হয় না। আতা রহ. ও কাতাদা রহ. বলেন, রোজাদার তার মুখের থুথু গিলে ফেলতে পারে। (বুখারী পরিচ্ছদঃ ১২১০)
শেষ কথা
মানুষ মাত্রই ভুল করে থাকে আর সেই ভুল ক্ষমার চোখে দেখেন বলেই আল্লাহ মহান ক্ষমাশীল। নিজেদের অজান্তে করা ভুলের তওবা করলে আল্লাহ নিশ্চয়ই ক্ষমা করবেন আমাদের, একই সাথে যাতে ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি না হয়, সেজন্যই জানাশোনা ও সচেতনতা জরুরী। আশা করি, লেখাটি সঠিকভাবে রোজা পালন করতে সচেতন করে তুলবে সকলকে।