ভারতীয় উপমহাদেশে যেসব নারীরা তাদের নিজের ক্ষমতা বলে ক্ষমতার চূড়ান্ত স্বাদ পেয়েছিল তাদের মধ্যে একজন ছিল নুরজাহান। নুরজাহান কে ও নুর জাহানের প্রকুত নাম কি? এসব নিয়ে আলোচনা করা হবে। আশাকরি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের এই আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়লে আপনি নুরজাহান সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবেন। এছাড়াও আর ও জানতে পারবেন নুরজাহানের রাজনৈতিক পরিচয় ও কার্যাবলী সম্পর্কে। তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক নুরজাহানের প্রকৃত নাম কি রাজনৈতিক পরিচয় সমূহ সম্পর্কে।
নুরজাহানের প্রকৃত নাম কি?
সময়টা ছিল 31শে মে 1577 খ্রিস্টাব্দের কোন এক দিন। মির্জা গিয়াস বেগ এর পরিবারে নুরজাহানের জন্ম হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায় নুরজাহানের পিতা মির্জা গিয়াস বেগ এর পরিবারে নুরজাহান কান্দাহারে জন্মগ্রহণ করেন। নুরজাহানের প্রকৃত নাম হলো মেহেরুন্নেসা। মেহেরুন্নেসা পিতা মির্জা গিয়াস বেগ তখন ভারতে এসে শেখ মাহমুদ নামে সম্রাট আকবরের দরবারে একটি চাকরি পায়।
সম্রাট আকবর মির্জা গিয়াস বেগ কে ইতিমাদ উদ দৌলা উপাধি দিয়ে তার রাজদরবারের চাকরি দেয়। মির্জা গিয়াস বেগ যখন শেখ মাহমুদ নামে সম্রাট আকবরের রাজদরবারে চাকরি নেয় তখন সেই সুযোগে মেহেরুন্নেসা রাজ দরবারে পিতার সাথে থাকতে শুরু করে। মেহেরুন্নেসা অপূর্ব সৌন্দর্য দেখে সম্রাট আকবরের ছেলে জাহাঙ্গীর তথা তখন নামছিল সেলিম সে পাগল হয়ে যায়।
সেলিম ও মেহেরুন্নেসার মধ্যে প্রেম বিনিময় আদান-প্রদান হতে থাকে। কোন এক সময়ে সম্রাট আকবর জেনে যায় মেহেরুন্নেসা ও তার ছেলে সেলিমের প্রেম কাহিনীর কথা। সম্রাট আকবর এটা কিছুতেই মেনে না নিয়ে নুরজাহান তথা মেহেরুন্নেসা কে ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান এর জায়গীর আলীকুলি বেঘ এর সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। আলিকুলি বেগ এর সাথে মেহেরুন্নেসার বিয়ের এভাবে কয়েক বছর চলতে থাকে।
এরপরে ১৬০৫ সালের কোন একটা সময়ে সম্রাট আকবর মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুবরণ করার সাথে সাথে সম্রাট আকবর এর ছেলে সেলিম তার নিজের নাম পাল্টিয়ে জাহাঙ্গীর রাখেন। জাহাঙ্গীর রাখার পর সে এসে সিংহাসনে বসেই ১৬০৭ সালে মেহেরুন্নেসার স্বামী আলিকুলি বেগ কে মেরে ফেলেন। আলিকুলি বেগ কে ফেলার পর সেলিম তথা সম্রাট জাহাঙ্গীর মেহেরুন্নেসা তথা নুরজাহান কে বিয়ে করেন।
জানা যায় যে মেহেরুন্নেসা তথা নুরজাহান ও সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬১১ সালের দিকে নববর্ষের উৎসব বিয়ের প্রস্তাব দেয়। এর কয়েক মাস পরে সম্রাট জাহাঙ্গীর মেহেরুন্নেসা কে ধুমধাম করে বিয়ে করে। বিয়ে করার পর সম্রাট জাহাঙ্গীর মেহেরুন্নেসা কে নতুন নাম নুরজাহান নাম প্রদান করে। সেইসাথে সম্রাট জাহাঙ্গীর তার অন্যান্য ১২ জন বেগমের প্রধান বেগম এর মর্যাদা দিয়ে দেয়। এভাবেই নুরজাহান সম্রাট জাহাঙ্গীরের বেগম হয়ে তার নিজের আধিপত্য বিস্তার লাভ করতে থাকে।
নূরজাহানের রাজনৈতিক পরিচয় ও কার্যাবলী
সম্রাট জাহাঙ্গীর নুরজাহান কে প্রচন্ড পরিমাণে ভালোবাসতো। আর এই অন্ধ প্রেমের কারণে এই অন্ধ প্রেমের সুযোগ নিয়ে নুরজাহান রাজদরবার তার নিজের আয়ত্বে নিয়ে নেয়। অনেক ভারতীয়রা এটা এটকা চক্র নামে চিনে থাকে। এই চক্রের সাহায্যে নুরজাহান পুরো মোঘল সাম্রাজ্য নিজের হাতে একটু একটু করে বা আয়ত্ত করে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে।
অনেক ঐতিহাসিকগণের মতে তিনি মোগল সাম্রাজ্যের প্রশাসনের প্রধান কার্যালয় নিয়ন্ত্রণ করত। এছাড়াও তার নির্দেশে মোগল সাম্রাজ্য পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হত। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে জানা যায় যে, নুরজাহান এর কৌশল ও বুদ্ধিমত্তা ছিল অত্যন্ত প্রচন্ড পরিমানে নিখুঁত। তিনি যখন কোনো সিদ্ধান্ত নিত সেটা খুব সহজেই নিখুঁত পরিকল্পনা করার মাধ্যমে নিতে পারত।
নুরজাহান তার পিতা মির্জা গিয়াস বেগ তথা ইতিমাদ উদ দৌলা কে নিয়ে মোগল সাম্রাজ্যের অনেকাংশ নিজের আয়ত্বে নিয়ে নিয়েছিল। নুরজাহানের সাথে আরো ছিল যুবরাজ খুররাম, ঈদমৎ খাঁ (ভাই), আসফ খাঁ (ভাই) ইত্যাদি। নুরজাহান এদের সাহায্যে পুরো মোগল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন বিষয়ে পরিচালনা করতে থাকে। তবে নুরজাহানের এই সাম্রাজ্য পরিচালনা সম্রাট জাহাঙ্গীরের অসুস্থতা ও অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণেই হয়েছিলো।
শুধু মদ্যপান গান বাজনা অভ্যস্ত এর কারনে যে নুরজাহান এই সাম্রাজ্য পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলো তাই নয়। এছাড়াও সম্রাট জাহাঙ্গীর ছিল নুরজাহানের প্রেমে মগ্ন। আর তাই নুরজাহান যা করতো তাতে কোনো ভাবেই সম্রাট জাহাঙ্গীর হস্তক্ষেপ করতে পারত না। অনেক ঐতিহাসিকগণ মনে করে যে সম্রাট জাহাঙ্গীরের মোঘল সাম্রাজ্য এই নুরজাহানের কারণে অনেক শক্ত পোক্ত ভাবে পরিচালনা করা গিয়েছিল।
যদি সম্রাট জাহাঙ্গীর নুরজাহান কে না পেত তাহলে সম্রাট জাহাঙ্গীর এত বড় মোঘল সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে পারত না। অনেক ঐতিহাসিকগণ মনে করে যে মুঘল সাম্রাজ্যে আরো অনেক অনেক ছোট হয়ে যেত এবং ধীরে ধীরে তা পতনের দিকে চলে যেত।
এভাবে নুরজাহান তার নিজের আয়ত্বে নিয়ে ভালো ভাবেই মুঘল সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে একদিন লাভলী বেগম এর সাথে জাহাঙ্গীরের কনিষ্ঠপুত্র শাহরিয়ার-এর বিয়ে দেওয়া পরে তাকে সিংহাসনে বসাতে চায়। এটা যখন জাহাঙ্গীরের অন্য পুত্র খুররম বুঝতে পারে তখন সে নুরজাহানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। এই বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে নুরজাহান মহাবৎ খাঁয়ের সাহায্য নেন। যখন মহাবৎ খাঁ এই বিদ্রোহ দমন করে তখন নুরজাহান বুঝতে পারে যে মহাবৎ খাঁয়ের ক্ষমতা প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আর তাই তিনি শংকিত হয়ে যান। তাই নুরজাহান মহব্বত খাঁ কে বাংলার সুবাদার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে দেয়। এভাবে নুরজাহান তার বুদ্বিমত্তা দিয়ে মহাবৎ খাঁ কে সরিয়ে মোগল সাম্রাজ্যের থেকে দূরে পাঠিয়ে দেয়। এভাবেই নুরজাহান তার স্বামীর সাম্রাজ্য নিজের আয়ত্তে করে মরার আগ পর্যন্ত চালিয়ে যেতে থাকে। নুরজাহান চক্র ভাঙ্গার পর থেকেই নুরজাহানের ক্ষমতা আস্তে আস্তে কমে যেতে থাকে। এভাবে নুরজাহান পুরো মোগল সাম্রাজ্য তার নিজের আয়ত্ত করে নিয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে ভালো ভাবেই পরিচালনা করতে পেরেছিল।
তিনি না থাকলে হয়তো এই মোগল সাম্রাজ্য অনেক আগেই অন্ধকারের দিকে চলে যেত। নুরজাহান যেমন এক রহস্যময়ী নারী ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে সেইসাথে নুরজাহান এর মত বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমত্তা ও বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণ দের কে ও তুলেছে। নুরজাহানের কারণেই মোগল সাম্রাজ্য আগামী কয়েক বছরের শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলতে পেরেছিল। জাহাঙ্গীরের দুর্বলতার কারণে যেভাবে মোগল সাম্রাজ্যে অধঃপতনের দিকে এগোচ্ছিল। ঠিক তখনই দেবদূত হয়ে আবির্ভাব হয়েছিল সম্রাট জাহাঙ্গীরের জীবনে এক রহস্যময়ী সুন্দরী নারী নুরজাহান এর। যে নারীর কারণ আজ মোগল সাম্রাজ্য বেশি ইতিহাস সৃষ্টি করতে পেরেছিল।
নুরজাহান যেভাবে মোগল সাম্রাজ্য কে তার নিজের আয়ত্তে উপরে নিয়ে ভালোভাবে পরিচালনা করতে পেরেছিল। ঠিক তেমনি ভাবে কিছু কিছু কারণে তিনি ইতিহাসবিদদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থেকে যায়। নুরজাহানের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে অনেক তথ্যই আমাদের কাছে হয়ত এখনো অজানা। বিভিন্ন বই-পুস্তক থেকে যতটুকু জানা যায় নুরজাহানের ইতিহাস এর থেকেও বেশি রহস্যময় ছিল নুরজাহানের ইতিহাস। তিনি যেমন পরম সুন্দরী ছিলো তেমন ছিল তার দক্ষ সুচক্ষন বুদ্ধিমত্তা। যা দিয়ে তিনি পুরো মোগল সাম্রাজ্য কে নিজের আয়ত্ত করে নিয়ে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতে পেরেছিল যা হয়ত ইতিহাসে বিরল। ইতিহাসে এমন রহস্যময় নারীর খুব কমই রয়েছে। তবু ও সম্রাট শাহজাহানের প্রাণ প্রিয় স্ত্রী নুরজাহানের ইতিহাস আমরা যতটুকু জানি সে তো অনেক রহস্য ভরা ছিল।
এভাবে নুরজাহান সম্রাট জাহাঙ্গীরের জীবনে একজন রক্ষাকারী দেব দুত হয়ে ও আবির্ভূত হয়েছে বলে অনেকের কাছ থেকে জানা যায়। অনেক ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাম্রাজ্য নুরজাহান বেগম খুব সুন্দর ভাবেই পরিচালনা করতে পেরেছিলেন। যদি ও এই নিয়ে অনেক ঐতিহাসিকগণদের মধ্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তবে এই থেকে ভারতীয় ইতিহাসে নুর জাহান যতটুকু জায়গা করে নিয়েছে সেটাই অনেক রহস্যভাবে আছে।
আশা করি আপনারা এখন নুরজাহান এর প্রকৃত নাম ও নুর জাহান এর রাজনৈতিক জীবনের অনেক তথ্য জানতে পারলেন। এর পর ও যদি আপনার কোন কিছু বুঝতে না পারেন বা কোন কিছু বুঝতে অসুবিধা হয় তাহলে অবশ্যই আমাদের কে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে আপনার সমস্যাটির সমাধান করে দেয়ার চেষ্টা করব। দেখা হবে আবার নতুন কোন আর্টিকেলে নতুন কোন বিষয় নিয়ে, ততক্ষণ পর্যন্ত আশা করি সবাই ভাল থাকবেন সুস্থ থাকবেন।