শিক্ষা সংবাদ

ধাপে ধাপে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা

তিনধাপে ২০২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা চালুর চিন্তাভাবনা করছে সরকার। প্রথম ধাপে এবার জুলাই মাসে ষষ্ঠ শ্রেণী আসবে অবৈতনিক শিক্ষার অধীনে। ২০২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মাধ্যমিক স্তর ২০২৫-এর মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক বা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষার অধীনে আসবে। বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা কর্মসূচি চালু রয়েছে। যদিও বেসরকারি হাইস্কুল সংলগ্ন প্রাথমিক শাখার শিক্ষার্থীদের টি্উশন ফি দিতে হয়।

সরকার বর্তমানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এমপিও বাবদ অর্থ দিচ্ছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের টিউশন ফিসহ অন্যান্য খরচ মেটাতে উপবৃত্তি বাবদ মোটা অংকের অর্থ ব্যয় করে। প্রতিষ্ঠানগুলো এর বাইরে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ টিউশনসহ অন্যান্য ফি বাবদ আদায় করে। কিন্তু সেই অর্থের প্রায় সবই প্রতিষ্ঠান নিজেদের মতো করে ব্যয় করে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, যদি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা অর্থের সদ্ব্যবহার করা যায় এবং এর সঙ্গে এমপিও ও উপবৃত্তির অর্থ যোগ করা যায়- তাহলে সহজেই অবৈতনিক শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের কোষাগার থেকে খুব সামান্যই ব্যয় করতে হবে।

সরকারের একজন নীতি নির্ধারক বলেন, একীভূত উপবৃত্তি কার্যক্রম ও এসডিজি-৪ (শিক্ষায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) এর আংশিক দিক অর্জনের লক্ষ্যে গত সেপ্টেম্বরে একটি প্রস্তাবনা তৈরি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ৩৬ পৃষ্ঠার ওই প্রস্তাবনায় এককেন্দ্র থেকে উপবৃত্তি কার্যক্রম পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। এতে এমডিজির (সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) মতোই আগাম এসডিজি অর্জনের লক্ষ্যে কর্মসূচি নির্ধারণ করা হয়।

জানা গেছে, দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনে বিস্তারিত গবেষণা হয়েছে। গবেষণায় ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পেছনের ব্যয় আলাদাভাবে নির্ধারণ করা হয়। এরপর সারাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শ্রেণিভিত্তিক মোট কত টাকা সরকার ব্যয় করবে তা বের করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে স্কুলের টিউশন ফি ও অন্যান্য ব্যয় হিসাবে আনা হয়েছে।

এ সংক্রান্ত কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, অবৈতনিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করা হলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো টিউশন ও অন্যান্য ফি আদায় করা হবে না। এর পরিবর্তে সরকার দুইভাবে টিউশন ফি সংস্থান করবে। একটি হচ্ছে, প্রত্যেক স্কুল-মাদ্রাসা একই হারে টিউশন ফি নেবে। সেই ফির অর্থ সরকার শিক্ষার্থীর কাছে পাঠাবে। শিক্ষার্থী তা স্কুলে জমা দেবে। অথবা, ধার্য টিউশন ফি সরকার সরাসরি প্রতিষ্ঠানে পাঠাবে।

এ ক্ষেত্রে সরকার যে টিউশন ফি নির্ধারণ করেছে, সেটি হচ্ছে- ষষ্ঠ শ্রেণিতে ১শ’ সপ্তমে ১৫০ টাকা। অষ্টম শ্রেণি প্রস্তাবিত ফি ২শ’ টাকা। নবম ও দশম শ্রেণিতে যথাক্রমে ৩শ’ ও ৫শ’ টাকা। একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে ৫শ’ টাকা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, উল্লিখিত এসডিজির জন্য প্রস্তাবিত টিউশন ফি কিংবা সমন্বিত উপবৃত্তির জন্য প্রস্তাবিত হারে অনুদানে আপাতত অবৈতনিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা যায়। ২০২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সরকার দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের টিউশন ও সেশন ফিসহ প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের ব্যয় বহন করবে।

জানা যায়, সরকার যদি টিউশন ফি প্রদান করে তাহলে চলতি বছর কেবল ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা অবৈতনিক শিক্ষার সুযোগ পাবে। এ ক্ষেত্রে এসব শিক্ষার্থীর বাবদ ৪ কোটি ৯ লাখ ৩৩ হাজার টাকা খরচ হবে। যদি আগামী বছর সপ্তম শ্রেণি অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাহলে দুই শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য মোট ব্যয় হবে ১০ কোটি ১৭ লাখ ১৯ হাজার টাকা।

২০২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা চালুর কথা বলা আছে বাস্তবায়ন কৌশলপত্রে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তিন শ্রেণিতে কেবল ফি বাদ দিতে হবে ১৮ কোটি ১৭ লাখ ৫ হাজার টাকা।

অবৈতনিক শিক্ষা নিশ্চিতের লক্ষ্যে এ সংক্রান্ত কৌশলপত্রে আরও বলা হয়, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দের জুলাইয়ে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে ৭৫ লাখ ৮২ হাজার ৮৭৫ ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া করবে। ২০১৫ ও ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের শিক্ষার্থী বৃদ্ধির হার পর্যালোচনা করে এই পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়।

শিক্ষার্থী বৃদ্ধির আনুপাতিক হার বিশ্লেষণ করে পরিসংখ্যানবিদরা বলছেন, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে ৮০ লাখ ৪৪ হাজার ৬৭৩ জন এবং ২০২৫ সালে ৯০ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫০ জন হবে। ২০৩০ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী হবে ১ কোটি ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৪৭৪। প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধির প্রস্তাবও আছে এতে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে (দশম শ্রেণী পর্যন্ত) শিক্ষার্থী কর্তৃক অন্যান্য ভাতা হিসেবে দেয়া অর্থের ৬৯ শতাংশ বা ৯ লাখ ৬৬ হাজার টাকার জোগান আসে নিম্ন মাধ্যমিক স্তর থেকে। সে ক্ষেত্রে নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে সরকারি খরচে শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যয় নির্বাহ করতে ২০২৫ সালে নিম্ন মাধ্যমিকের ৩০ হাজার ৩৫৮টি প্রতিষ্ঠানে ৪২ কোটি ৯৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা সরকারিভাবে বরাদ্দ করতে হবে। ২০২৫ সালে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ৪৪ কোটি ৩৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। ২০২৫ সালে লাগবে ৪৭ কোটি ৪২ হাজার ৬২ হাজার টাকা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবনায় নবম-দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী এবং তাদের পেছনে সম্ভাব্য ব্যয়ের চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, ২০১৬ সালের নবম-দশম শ্রেণীতে শিক্ষার্থী ছিল ৩৮ লাখ ৫০ হাজার ৮শ’। চলতি বছর এই সংখ্যা দাঁড়াবে ৪০ লাখ ৮৫ হাজার ৩১৪ জন। ২০২৫ সালে এই সংখ্যা হবে ৪৩ লাখ ৩৪ হাজার ১০৯ জন। ২০২৫ সালে হবে ৪৮ লাখ ৭৮ হাজার ৭৮ জন। আর ২০৩০ সালে দাঁড়াবে ৫৬ লাখ ৫৫ হাজার ৩০ জনে।

একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের আয়ের ৩১ শতাংশ আসে এই দুই শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের দেয়া বিভিন্ন ধরনের ফি থেকে। এর পরিমাণ প্রতি প্রতিষ্ঠানে গড়ে ৪৩ হাজার ৪শ’ টাকা। সেই হিসাবে ২০২৫ সালে ২৮ হাজার ৭৬৯ প্রতিষ্ঠানে কেবল নবম-দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য ৩১ কোটি ৯৮ লাখ ৯২ হাজার টাকা সরকারি কোষাগার থেকে দিতে হবে।

২০২৫ সালে এই পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান হবে ২৯ হাজার ৯৩৬টি। এই খাতে সরকারি কোষাগার থেকে দেয়ার প্রয়োজন হবে ৩৪ কোটি ৯৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। ২০৩০ সালে প্রয়োজন হবে ৩৯ কোটি ১০ লাখ ২১ হাজার টাকা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে সরকার একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সরকারি খরচে শিক্ষা সুবিধা নিশ্চিতের চিন্তাভাবনা করছে। ২০১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে শিক্ষার্থী বৃদ্ধির হার বিবেচনা করে দেখা গেছে, এটা ৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এটিকে আমলে নিয়ে পরিসংখ্যানবিদরা বলছেন, ২০২৬ খ্রিস্টাব্দে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থী হবে ১০ লাখ ১১ হাজার ৭৭৩ জন।

একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীর জন্য জনপ্রতি টিউশন ফি ৫শ’ টাকা এবং অন্যান্য ফি ২ হাজার টাকা ধরে অবৈতনিক শিক্ষা চালু করতে পারে সরকার। সে ক্ষেত্রে জনপ্রতি বছরে ৮ হাজার টাকা করে সরকারকে সংস্থান করতে হবে।

এই হিসাবে ২০২৬ খ্রিস্টাব্দে ১০ লাখ ১১ হাজার ৭৭৩ শিক্ষার্থীর জন্য ৮ কোটি ৯ লাখ ৪২ হাজার টাকা সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় করতে হবে। ২০৩০ খ্রিস্টাব্দে এই স্তরে সম্ভাব্য শিক্ষার্থী ধরা হয়েছে ১২ লাখ ২৯ হাজার ৮১৭ জন। তখন এই স্তরে সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় করতে হবে ৯৮৩ কোটি ৮৫ হাজার টাকা।

জানা যায়, ২০২৬ খ্রিস্টাব্দে যখন দ্বাদশ পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা বাস্তবায়ন হবে, তখন ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা চালু করতে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যয় হিসেবে খরচ করতে হবে ৯২ কোটি ১০ লাখ ২৩ হাজার টাকা।

About Author

I hope you are enjoying this article. Thanks for visiting this website.