social work

তোমাদের জন্য আজ এইচএসসি পরীক্ষা সমাজকর্ম ১ম পত্র বিষয়ের অ্যাসাইনমেন্ট এর বাছাইকরা উত্তর- শিল্প বিপ্লবের ফলে সমাজকর্ম পেশার উত্থান এবং বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মুখােমুখি- ভবিষ্যৎ সমাজকর্মী হিসাবে করণীয় নির্ধারণ নিয়ে হাজির হলাম।

অ্যাসাইনমেন্ট :

শিল্প বিপ্লবের ফলে সমাজকর্ম পেশার উত্থান এবং বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মুখােমুখি-ভবিষ্যৎ সমাজকর্মী হিসাবে করণীয় নির্ধারণ;

নির্দেশনা (সংকেত/ধাপ/পরিধি) :

  • ১) দৃষ্টান্তসহ শিল্প বিপ্লবের ধারণা;
  • ২) শিল্প বিপ্লবের প্রভাব বর্ণনা (ইতিবাচক ও নেতিবাচক);
  • ৩) সমাজকর্ম পেশার উত্থানে শিল্প বিপ্লবের ভূমিকা;
  • ৪) সম্ভাব্য ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের পরিবর্তিত দিকসমূহ ভবিষ্যৎ সমাজকর্মীর করণীয়;

ক) শিল্প বিপ্লবের ধারণাঃ

শতকের দ্বিতীয়ার্ধে দৈহিক শ্রমের পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি ও তার গুণগত মানের ক্ষেত্রে যে ব্যাপক উন্নতি হয়, তাকেই সাধারণভাবে ‘ শিল্প বিপ্লব ’ ( Industrial Revolution ) বলা হয়। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি সমাজতন্ত্রী নেতা লুই অগাস্তে ব্ল্যাঙ্কি ( Louis Auguste Blanqui ) শিল্প বিপ্লব কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন।

১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় শিল্প বিপ্লব কথাটি ব্যবহার করেন জার্মান সমাজতন্ত্রী দার্শনিক ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস ( Friedrich Engels )। তবে ১৮৮০-৮১ খ্রিস্টাব্দে শিল্প বিপ্লব কথাটিকে জনপ্রিয় করেছিলেন বিশিষ্ট ব্রিটিশ ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়েনবি ( Arnold Toynbee )। সর্বপ্রথম ইউরোপের ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব (বস্ত্রশিল্পে) হলেও এর সূচনা কাল নিয়ে অনেক মতভেদ আছে।

ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের কারণ ও ফলাফল ইতিহাসে মোটামুটি ১৭৬০-১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দ এই সময়কালে কৃষি এবং বাণিজ্যিক ব্যবস্থা থেকে আধুনিক শিল্পায়নের দিকে গতি শুরু হওয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটে। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর সমুদ্র যাত্রা বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যের পথ খুলে দেয়। এরপর পুঁজিবাদের উদ্ভব, বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কার, কয়লার খনি আর ইস্পাতের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে অনেক শিল্প শহর আর কারখানা গড়ে উঠে। শিল্পবিপ্লব কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন অগাস্ত ব্লাংকি ১৮৩৮ সালে। পরবর্তীকালে জন স্টুয়ার্ট মিল ও কাল মার্কস শিল্প বিপ্লব কথার প্রয়োগ করেন।

ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব (১৭৬০ থেকে ১৮৪০)

মূলকারণ:

(১) ইংল্যান্ডের প্রাকৃতিক পরিবেশ,

(২) সুলভ শ্রমিক,

(৩) অফুরন্ত মূলধন,

(৪) উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা,

(৫) বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির আবিষ্কার,

(৬) উপনিবেশিক সাম্রাজ্যের প্রসার ইত্যাদি।

শিল্প বিপ্লবের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Industrial Revolution. এই শব্দটি সর্ব প্রথম ব্যবহার করেন ইংরেজ ঐতিহাসিক Arnold Tynbee. ১৮৮০ সালে তিনি তাঁর লেখা “Lectures on the Industrial Revolution in England” গ্রন্থে এটা ব্যবহার করেন। ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার নানারকম কারণের মধ্যে একটি বড় কারণ ছিল পুঁজির জোগান। এই পুঁজির অনেকটাই এসেছিল ঔপনিবেশিক ব্যাবসাবাণিজ্য থেকে। ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে দুটি সমস্যা দেখা দেয়। কাঁচামালের অভাব এবং উদ্বৃত্ত দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয়ের জন্যে বাজার। এই দুটি সমস্যা সমাধানের একটি উপায় হল উপনিবেশ স্থাপন। খনিজ ও বাণিজ্যিক কৃষিতে সমৃদ্ধ উপনিবেশ থেকে একদিকে যেমন কাঁচামাল সংগ্রহ করা সম্ভব, তেমনই অন্যদিকে সেখানেই উদ্বৃত্ত দ্রব্যসামগ্রীর বিক্রয়েরও সুযোগ ছিল। একাজ অবশ্যই সহজসাধ্য ছিলনা। উপনিবেশগুলির পক্ষে এই ব্যবস্থা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলনা। ইংল্যান্ড আমেরিকায় তার এই নীতি অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল।

১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকা স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। কিন্তু ভারতসহ এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ইংরেজরা বাহুবলে তাদের উপনিবেশ ও সাম্রাজ্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল। সাধারণভাবে উপনিবেশবাদ বলতে বোঝায় এমন এক ব্যবস্থা যাতে মাতৃভূমির স্বার্থে বাহুবলে অধিকৃত এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলিকে শোষণ করা হয়। ঔপনিবেশিক অর্থনীতিতে স্থানীয় শিল্পের যাতে কোনো বিকাশ না-হয়, অথবা যেখানে উন্নত হস্ত বা কুটির শিল্প আছে, তার যাতে পতন বা ধবংস অনিবার্য হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা হয়। অর্থাৎ, উপনিবেশগুলির স্বাধীনভাবে অর্থনীতি নির্ধারণ করবার কোন সুযোগ ও স্বাধীনতা থাকে না।

ইংল্যান্ডে প্রথম শিল্প বিপ্লব হওয়ায় উপনিবেশ স্থাপনে ইংল্যান্ড ছিল সবচেয়ে অগ্রণী। তার সাম্রাজ্য ছিল বিশ্বজুড়ে। কথাই ছিল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কখনও সূর্য অস্ত যায়না। তারপরেই ছিল ফ্রান্সের স্থান, যদিও ফ্রান্সে শিল্প বিপ্লব হয়েছিল বেশ কিছুটা দেরিতে। জার্মানি, রাশিয়া ও ইতালিতে আরও পরে শিল্প বিপ্লব হয়েছিল বলে উপনিবেশ স্থাপনের প্রতিযোগিতায় তারা অনেক পিছিয়ে ছিল। যাই হোক, উনিশ শতকের শেষ পর্বে আফ্রিকার প্রায় সর্বত্র এবং এশিয়ার এক বৃহৎ অংশ জুড়ে উপনিবেশ স্থাপিত হয়েছিল।

খ) শিল্প বিপ্লবের প্রভাব (ইতিবাচক ও নেতিবাচক)

শিল্প বিপ্লবের ইতিবাচক প্রভাবঃ

1) নগরকেন্দ্রিক সমাজ সৃষ্টি : শিল্পবিপ্লবের ফলে শিল্প বা কলকারখানা ও ব্যাবসাথলকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন নগরের সৃষ্টি হয়। গ্রামের কৃষক ও সাধারণ মানুষ অর্থ উপার্জন ও উন্নত জীবনযাপনের জন্য দলে দলে শহরে আসতে থাকে। এর ফলে নগরকেন্দ্রিক সমাজ ও সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়।

2) বিলাসবহুল জীবনযাপন : শিল্পবিপ্লবের ফলে পরিধেয় থেকে পরিবহন সর্বক্ষেত্রে আরাম ও বিলাসের অজস্র উপকরণ নির্মিত হতে থাকে। অর্থের বিনিময়ে সেইসব দ্রব্য ক্রয় করে মানুষ নিজেদের জীবনকে বিলাসবহুল করে তােলে।

3) প্রকৃতিকে জয় : শিল্পবিপ্লবের ফলে আবিষ্কৃত বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির দ্বারা মানুষ প্রাকৃতিক শক্তিকে জয় করার কাজে লিপ্ত হয়। কয়লা , খনিজ তেল , জল প্রভৃতি প্রাকৃতিক উপাদান থেকে বিদ্যুৎ তৈরিতে মানুষ সক্ষম হয়।

4) সময়ের সাশ্রয় : শিল্পবিপ্লবের ফলে কায়িক শ্রমের পরিবর্তে যন্ত্রের দ্বারা অল্প সময়ে অধিক দ্রব্য উৎপাদনে মানুষ সক্ষম হয়। এর ফলে সময়ের অনেক সাশ্রয় হয়।

5) শ্রমবিভাজন নীতির উদ্ভব : শিল্প বিপ্লব এর পূর্বে একজন শ্রমিক নিজে সম্পূর্ণ একটি দ্রব্য তৈরি করত। কিন্তু শিল্পবিপ্লবের ফলে একটি দ্রব্য বিভিন্ন শ্রমিকের মিলিত শ্রমে তৈরি হয়। অর্থাৎ একজন শ্রমিক একটি দ্রব্যের একটি অংশ তৈরির সঙ্গে যুক্ত হয় — পুরাে দ্রব্যের সঙ্গে নয়। ফলে বিশেষীকরণের ( Specialization ) উদ্ভব হয় এবং দ্রব্যের গুণগত মান বৃদ্ধি পায়।

6) ব্যাবসা বাণিজ্যের প্রসার : শিল্প বিপ্লব এর ফলে দ্রব্যের উৎপাদন প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল। ইংল্যান্ডের উৎপাদিত সামগ্রী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বাজারে ছেয়ে গিয়েছিল।

শিল্প বিপ্লবের নেতিবাচক প্রভাবঃ

শিল্প বিপ্লব মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। শিল্পবিপ্লব সমাজ , রাষ্ট্র ও অর্থনীতির উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। মানবসভ্যতার প্রগতির পথে শিল্পবিপ্লব ছিল আশীর্বাদস্বরূপ। কিন্তু এই শিল্পবিপ্লব আশীর্বাদের সঙ্গে কিছু কিছু অভিশাপও বয়ে নিয়ে আসে। যেমন-

1) জনশূন্য গ্রাম : শিল্পবিপ্লবের ফলে গ্রামের মানুষ কাজের আশায় শহরে এসে ভিড় জমালে গ্রামগুলি জনশূন্য হয়ে পড়ে। লােকসংখ্যার অভাবে গ্রামগুলি ধ্বংসের সম্মুখীন হয়।

2) কুটিরশিল্পের ধ্বংসসাধন : শিল্পবিপ্লবের ফলে নতুন নতুন যন্ত্রের আবিষ্কার হয়। এইসব যন্ত্রের সাহায্যে কলকারখানায় অল্প সময়ে ব্যাপক উৎপাদন হলে কুটিরশিল্পগুলি ধ্বংসের মুখে পড়ে।

3) শােষক শ্রেণির আবির্ভাব : শিল্প বিপ্লবের ফলে সমাজে মালিক শ্রমিক — এই দুই নতুন শ্রেণির আবির্ভাব হয়। মালিকশ্রেণি শ্রমিকদের শােষণ করে মূলধনের পাহাড় জমা করে। এই কারণে মালিকশ্রেণি শােষক শ্রেণি হিসেবে বিবেচিত হয়।

শিল্প বিপ্লবের ফলে সমাজকর্ম পেশার উত্থান এবং বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মুখােমুখি- ভবিষ্যৎ সমাজকর্মী হিসাবে করণীয় নির্ধারণ

4) মালিক ও শ্রমিকশ্রেণির সংঘাত : কলকারখানার মালিকরা শ্রমিকদের শােষণ করে অধিক অর্থ উপার্জনে সচেষ্ট হয়। ফলে অত্যধিক কাজের চাপ , অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান, অমানবিক আচরণ শ্রমিকদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তােলে এর ফলস্বরূপ শ্রমিক ও মালিকশ্রেণির মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়।

5) ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা : শিল্পবিপ্লবের ফলে পণ্যের উৎপাদন ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রির জন্য ইংল্যান্ড – সহ ইউরােপের অন্যান্য কয়েকটি দেশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়। ফলে শিল্পোন্নত দেশগুলির মধ্যে উপনিবেশ দখলের লড়াই শুরু হয়।

6) ঔপনিবেশিক শােষণ : শিল্প বিপ্লবের ফলে শিল্পমালিকেরা কাঁচামাল সংগ্রহ এবং উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রির জন্য উপনিবেশ বিস্তার করে। উপনিবেশের কাঁচামাল, ভূখণ্ড, জনসংখ্যা প্রভৃতির উপর শিল্পমালিকেরা আধিপত্য স্থাপন করে শােষণ চালাতে থাকে।

7) শ্রেণিবৈষম্য সৃষ্টি : শিল্প বিপ্লবএর ফলে শ্রমিক ও মালিকশ্রেণির মধ্যে বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করে। কারণ মালিকরা সর্বদা শ্রমিকদের শােষণ করে ধনী হয় এবং শ্রমিকরা শােষিত হতে হতে শােষণের শেষপ্রান্তে পৌছােয়।
ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব ইতিহাসের পাতায় একটি উল্লখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

(গ) সমাজকর্মের বিকাশে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব

সমাজকর্মের মূল উৎস হিসেবে শিল্প বিপ্লবকে চিহ্নিত করা হয়। শিল্প বিপ্লব যেমন মানব সভ্যতার সামগ্রিক রূপ বদলে দেয়, তেমনি পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, সনাতন সমাজসেবা কার্যক্রমকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার প্রয়োজন সৃষ্টি করে, যা হতে পেশাদার সমাজ কর্মের উদ্ভব হয়। মানব সভ্যতার মতো সমাজকল্যাণ ধারাকেও শিল্প বিপ্লব দু’ভাগে ভাগ করেছে। একটি মানবতাবোধ ও ধর্মীয় অনুশাসনের ভিত্তিতে পরিচালিত প্রাক শিল্প যুগের ঐতিহ্যগত সমাজকল্যাণ ধারা। আর অন্যটি হলো শিল্প বিপ্লবোত্তর সমাজব্যবস্থার জটিল সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনে উদ্ভূত পেশাদার সমাজকল্যাণ তথা সমাজকর্মের ধারা। সমাজকর্মের বিকাশে শিল্প বিপ্লবের প্রভাবের বিশেষ দিকগুলো এখানে উল্লেখ করা হলো-

১. বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজকল্যাণ দর্শনের উদ্ভব ‍:

শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। এ পরিবর্তনের ঢেউ মানুষের চিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। শিল্প বিপ্লব উৎপাদন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনয়নের সঙ্গে সমাজব্যবস্থার ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের সূচনা করে। যেমন শ্রমিক-মালিক বিরোধ, শিল্প শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা, পেশাগত দুর্ঘটনা, বাসস্থান সমস্যা, বসিত্ম ও নগর সমাজের প্রসার, নতুন নতুন সামজিক শ্রেণীর উদভব, মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব প্রভৃতি।

শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে সৃষ্ট পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহ্যগত ও গতাণুগতিক সেবা ব্যবস্থা অনেকটা অকার্যকর এবং অপ্রতুল হয়ে পড়ে। প্রয়োজন দেখা দেয় সমস্যা ও সমাজের চাহিদাভিত্তিক সেবা ব্যবস্থা। উদ্ভব হয় নতুন চাহিদাভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের সেবা কার্যক্রম। এভাবে শিল্প সমাজের জটিল ও বহুমুখী সমস্যা সমাধানের তাগিদে সমাজকল্যাণে ধর্মীয় এবং মানবপ্রেমের আদর্শের চেয়ে মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আদর্শের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়।

২. সমস্যা সমাধানে বহুমুখী দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ‍:

শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে সমাজকাঠামো জটিল আকার ধারণ করে। ফলে সামাজিক সমস্যাগুলো প্রকৃতিগত দিক হতে জটিল হয়ে উঠে। শিল্প বিপ্লবের পর অর্থনৈতিক সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয় সামাজিক, মানসিক, নৈতিক এবং নিরাপত্তাজনিত সমস্যা। পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের ব্যর্থতাজনিত কারণে বহুমুখী জটিল সমস্যা সৃষ্টি হয়। এসব জটিল ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বহুমুখী সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে, ধর্মীয় অনুশাসন ও মানবিক আদর্শভিত্তিক সমাজসেবার পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিভিত্তিক সমাজসেবা কার্যক্রমের প্রয়োজন দেখা দেয়। ফলে সামাজিক সমস্যা বিশ্লেষণ ও মোকাবেলায় সমাজ বিজ্ঞানীদের মধ্যে বহুমুখী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠে।

৩. বিজ্ঞানসম্মত সুসংগঠিত সমাজসেবার বিকাশ ‍:

শিল্প-বিপ্লবোত্তর বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সুসংগঠিত ও সুপরিকল্পিত সামজকল্যাণ ধারার উদ্ভব হয়। মনীষী টিমস্ যথার্থই বলেছেন, ‘আধুনিক সমাজকর্ম, আধুনিক সমাজ ব্যবস্থারই ফল। ধর্মীয় অনুপ্রেরণা ও মানবতাবোধের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। আধুনিক রাষ্ট্রে যারা সমাজসেবার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে, তারা সেগুলো নাগরিক অধিকার হিসেবেই ভোগ করছে। তারা কারো দয়া বা করুণার পাত্র নয়।’’ শিল্প বিপ্লবই আধুনিক সমাজকল্যাণের প্রয়োজন সৃষ্টি করেছে। শিল্প সমাজের প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতেই সমাজকল্যাণের নতুন নতুন ধারণার উদ্ভব হয়েছে। ধর্মীয় অনুশাসন ও মানবতাবোধের অনুপ্রেরণায় সংগঠিত দানশীলতা শিল্প বিপ্লবের পর পর্যায়ক্রমে বৈজ্ঞানিক দানশীলতায় পরিণত হয়ে সমাজকর্ম পেশার বিকাশ ঘটায়।

৪. সামগ্রিক উন্নয়ন ও স্বাবলম্বনের প্রতি গুরুত্বারোপ ‍:

শিল্প বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট সমস্যার মোকাবেলা করতে গিয়ে সাময়িক ও স্বাবলম্বন নীতি বর্জিত এলাকাভিত্তিক সমাজসেবা কার্যক্রমের পরিবর্তে সর্বজনীন কল্যাণ, সামগ্রিক উন্নয়ন এবং স্বাবলম্বন নীতির ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত সমাজকল্যাণের সূচনা হয়। প্রাক-শিল্প যুগের প্রতিকারমূলক সামাজকল্যাণ ধারার সঙ্গে প্রতিরোধ এবং উন্নয়নমূলক সমাজকল্যাণ ধারণার প্রসার ঘটে।

৫. পদ্ধতিগত সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য অর্জন ‍:

শিল্প-বিপ্লবোত্তর জটিল সামাজিক সমস্যার মোকাবেলা করতে গিয়ে সমাজকল্যাণে বিশেষ কতগুলো পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়। ব্যক্তি, দল ও সমষ্টিগত পর্যায়ে সৃষ্ট সমস্যার প্রকৃতিগত পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্ন ভিন্ন সমাধান কৌশল প্রয়োগের প্রয়োজন দেখা দেয়। ফলে সমাজকল্যাণ পদ্ধতিগত সমস্যা সমাধান প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য অর্জনে সক্ষম হয়।

৬. সমাজকল্যাণের পেশাদারী মর্যাদা অর্জন ‍:

শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে সমাজকল্যাণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হচ্ছে এর পেশাদারী মর্যাদা অর্জন এবং প্রায়োগিক সামাজিক বিজ্ঞানের স্বীকৃতি লাভ। শিল্প বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট জটিল ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত সমস্যা সমাধানকল্পে সমাজকল্যাণে পেশাগত শিক্ষা কার্যক্রমের সূত্রপাত ঘটে। শিল্প বিপ্লব সনাতন সমাজকল্যাণ ধারাকে সংগঠিত করে প্রাতিষ্ঠানিক এবং পদ্ধতিগত ধারায় রূপান্তরিত করেছে।

৭. বিশেষ ধরনের কল্যাণমূলক কর্মসূচির উদ্ভব ‍:

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাবে সংঘটিত শিল্প বিপ্লব মানুষের জীবন ধারার মধ্যে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন সাধন করছে। অব্যাহত পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন বহুমুখী চাহিদা। যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সমাজসেবার ক্ষেত্রে আসছে শিশুকল্যাণ, পরিবারকল্যাণ, ডে-কেয়ার, সামাজিক নিরাপত্তা,, প্রবীণ কল্যাণ, অপরাধ সংশোধন ইত্যাদি কর্মসূচি।

আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত সমাজকল্যাণের ঐতিহাসিক পটভূমি আলোচনা করলে স্পষ্ট হয়ে উঠে শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে সৃষ্ট জটিল সামাজিক সমস্যা মোকাবেলার প্রয়োজনে আধুনিক সমাজকল্যাণের উদ্ভব। শিল্প বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট সমস্যাদির জটিলতার পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মীয় অনুশাসন এবং মানবিক দর্শনের ভিত্তিতে পরিচালিত সমাজসেবা কার্যক্রম অপর্যাপ্ত বলে প্রতীয়মান হওয়ায় সুপরিকল্পিত এবং সুসংগঠিত সমাজসেবার প্রয়োজন অনুভূত হয়, যার ফলে আধুনিক সমাজকল্যাণের উদ্ভব।

সমাজকর্ম শিক্ষার বিকাশে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব :

যে কোন পেশার অপরিহার্য উপাদান হলো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন ছাড়া পেশার পরিপূর্ণতা আসে না। সমাজকর্ম শিক্ষা হলো সমাজকর্মীদের পেশাগত অভিজ্ঞতা অর্জন এবং প্রস্ত্ততি গ্রহণের আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ, যাতে প্রশিক্ষানার্থী পেশাগত ভূমিকা পালনের তাত্ত্বিক জ্ঞান ও ব্যবহারিক অনুশীলন দক্ষতা অর্জন করতে পারে।

পেশাদার সমাজকর্মের বিকাশে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব ছিল সুদুরপ্রসারী ও দীর্ঘমেয়াদী। শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে সৃষ্ট সামাজিক, আর্থিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মানসিক প্রভৃতি বহুমুখী সমস্যার সৃষ্টি হয়, যেগুলো মোকাবেলার প্রয়োজনে পেশাদার সমাজকর্ম শিক্ষার প্রয়োজন অনুভূত হয়। এজন্য শিল্প বিপ্লবকে পেশাদার সমাজকর্মের মতো পেশাগত শিক্ষারও মূল উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
শিল্প বিপ্লবের সুদূরপ্রসারী প্রভাব মানুষের চিন্তা ধারার ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন বয়ে আনে। মানুষ হয়ে উঠে যুক্তিবাদী, বৈজ্ঞানিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। ফলে মানুষ সমস্যাকে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে শুরু করে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময় থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যায়- এসময়ের মধ্যে সমাজকর্ম সুসংগঠিত সাহায্য কার্যক্রম হতে মানব জ্ঞানের পেশাগত শাখায় বিবর্তিত হয়। প্রথমদিকে সাহায্য কার্যক্রম স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। স্বেচ্ছাসেবীরা তাদের জ্ঞান ও কর্মদক্ষতা প্রশিক্ষণার্থী ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্জন করতো। সময়ের বিবর্তনে সমাজকর্মের পেশাগত শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রসারিত হয়। সমাজকর্মের অভিন্ন সাধারণ অনুশীলন কাঠামো গড়ে উঠে। শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে শিল্পায়ন ও শহরায়ন দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে। ধনী দরিদ্রের বৈষম্য ব্যাপক আকার ধারণ করে। বেকারত্ব, নিরাপত্তাহীনতা, পারিবারিক ভাঙ্গন, স্থানান্তর প্রভৃতি সমস্যা মোকাবেলার লক্ষ্যে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে সাহায্য কার্যক্রম গড়ে উঠে। সমাজকর্মের পেশাগত শিক্ষার সূচনায় এসব সমাজসেবা কার্যক্রমে নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবীরা অগ্রনী ভূমিকা পালন করে। এপ্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, যেকোন পেশাগত শিক্ষা কার্যক্রম তিনটি পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে বিকাশ লাভ করে।

  • প্রথম পর্যায়ে, স্বেচ্ছাসেবী ও বিভিন্ন সমাজসেবা প্রতিষ্ঠান ও এজেন্সীর বেতনভুক কর্মীরা, সমাজকর্ম বিশারদদের অধীনে শিক্ষানবীশ হিসেবে সমাজকর্মের উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। এ পর্যায় সমাজকর্ম শিক্ষার সূচিপর্ব হিসেবে চিহ্নিত।
  • দ্বিতীয় পর্যায়ে, আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনায় স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করা হয়।
  • তৃতীয় পর্যায়ে, প্রশিক্ষণ কোর্সগুলো শিক্ষা কর্মসূচিতে রূপামত্মরিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আত্মীকরণ করা হয়।

শিক্ষানবীশ হিসেবে সমাজকর্মীদের প্রশিক্ষণ ‍:

সমাজকর্মের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর পূর্বে স্বেচ্ছাসেবী ও বেতনভুক সমাজকর্মীরা বিভিন্ন সমাজসেবা প্রতিষ্ঠান ও এজেন্সীর নির্বাহী এবং অভিজ্ঞ সমাজকর্ম বিশারদদের অধীনে শিক্ষানবীশ হিসেবে সমাজকর্মের ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতো। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ইংল্যান্ডের মধ্যবিত্ত পরিবারের মহিলাদের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে দরিদ্র পরিবার পরিদর্শনের জন্য ফ্রেন্ডলি ভিজিটর্স হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। আধুনিক সুসংগঠিত পেশাদার সমাজকর্ম অনুশীলন এসব বন্ধুপ্রতীম পরিদর্শকদের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল।

পরবর্তীতে এসব পরিদর্শকগণ বেতনভুক কর্মচারী হিসেবে সি.ও.সি এর নিয়োগ লাভ করে। এরাই সমাজকর্মী হিসেবে কালক্রমে পরিচিতি লাভ করে। এদের প্রধান কাজ ছিল দরিদ্রদের গৃহ পরিদর্শন, সমস্যার কারণ নির্ণয়, সমস্যা সমাধানের নির্দেশনা প্রদান এবং দুঃস্থদের বস্ত্তগত সাহায্য প্রদান। এসব কর্ম সম্পাদনের জন্য তাদেরকে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহের অভিজ্ঞ কর্মীদের নিকট শিক্ষানবীশ হিসেবে প্রশিক্ষণ নিতে হতো। এধরনের প্রশিক্ষণ হতে সমাজকর্ম শিক্ষার সূচনা হয়।

সমাজকর্মের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা ‍:

ঊনিশ শতকের শেষার্ধে দরিদ্র ও নির্ভরশীলদের প্রদত্ত সেবার মান ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সামাজিক এজেন্সীগুলো সমাজকর্ম শিক্ষা বিবর্তনে বিশেষ অবদান রাখে। শিল্প বিপ্লবের প্রভাবজনিত সমস্যা মোকাবেলায় ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক মন্দা, গণবেকারত্ব এবং ১৮৬০ সালের বাণিজ্যিক মন্দার প্রাক্কালে বহু দান সংগঠন সমিতি গড়ে উঠে। সরকারি-বেসরকারি সাহায্য কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত হয়। এমতাবস্থায় মানবহিতৈষীদের প্রচেষ্টায় আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে দান সংগঠন সমিতি গঠিত হয়।

আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দা ও দুর্ভিক্ষের প্রভাবে সৃষ্ট সমস্যা মোকাবেলার জন্য সি.ও.সি এর নেতৃবৃন্দ স্বেচ্ছাসেবীদের জায়গায় বেতনভুক কর্মী নিয়োগের চিন্তাভাবনা করেন। এসব বেতনভুক কর্মচারীদের মাধ্যমে কার্যকর সেবা প্রদান নিশ্চিত করার জন্য কিছু আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন দেখা দেয়।

সমাজসেবার ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মনীষী মেরী ই. রিচমন্ড ১৮৯৭ সালে নেশনাল কনফারেন্স অন চ্যারিটিস এন্ড কারেকশন -এ একটি ট্রেনিং স্কুল ইন এপ্লিয়েড ফিল্যনথ্রপি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উপস্থাপন করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৮ সালে ছয় সপ্তাহের গ্রীষ্মকালীন প্রশিক্ষণ কোর্স শুরু করে। এরূপ প্রশিক্ষণ কোর্সের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে অন্যান্য শহরে অনুরূপ কোর্স খোলা হয়। পরবর্তীতে নিউ ইয়র্ক স্কুল অফ পিলেনথরাপি এক বছরের সমাজকর্ম শিক্ষা কর্মসূচি আরম্ভ করে। যা পর্যায়ক্রমে নিউ ইয়র্ক স্কুল অফ সোস্যাল ওয়ার্ক এ পরিণত হয়। ১৯৬২ সালের দিকে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আত্মীকৃত হয়ে কলোম্বিয়া ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ সোস্যাল ওয়ার্ক এ পরিণত হয়।

ঘ) সম্ভাব্য চতুর্থ শিল্প বিপ্লব পরিবর্তিত দিক

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (বা ইন্ডাস্ট্রি ৪.০) হলো আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্প ব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া। স্বয়ংক্রিয়করণ , উন্নত যোগাযোগ এবং স্ব-পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সমস্যার বিশ্লেষণ এবং নিরুপণ করতে সক্ষম স্মার্ট মেশিন তৈরী করার জন্য বড় আকারে মেশিন-টু-মেশিন যোগাযোগ (এমটুএম) এবং ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) কে একসাথে করা হয়েছে।

পরিকল্পনা নীতিমালা এবং লক্ষ্যমাত্রা সম্পাদনা শিল্প ৪.০ এর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে চিহ্নিত চারটি পরিকল্পনা নীতি রয়েছে।

  • আন্তঃসংযোগ – মেশিন, ডিভাইস, সেন্সর এবং মানুষের পরস্পরের মধ্যে ইন্টারনেট অফ থিংস অথবা ইন্টারনেট অফ পিউপল (আইওপি) এর মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন এবং যোগাযোগের ক্ষমতা।
  • তথ্যের স্বচ্ছতা – ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ তথ্যের স্বচ্ছতা দেয় যা অপারেটরদের সিদ্বান্ত নেওয়ার জন্য ব্যাপক তথ্য সরবরাহ করে। আন্তঃসংযোগের কারনে অপারেটর উৎপাদন প্রক্রিয়ার সমস্ত পয়েন্ট থেকে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করতে পারে এবং সেসব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা শনাক্ত করতে পারে যেগুলো সিস্টেমের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করলে আরও কার্যকর হবে।
  • প্রযুক্তিগত সহায়তা – সিদ্বান্ত গ্রহণ এবং সমস্যার সমাধানে মানুষকে সহায়তা করার জন্য সিস্টেমের প্রযুক্তিগত সুবিধা এবং কঠিন বা অনিরাপদ কাজের ক্ষেত্রে সহায়তা করার ক্ষমতা।
  • বিকেন্দ্রীভূত সিদ্ধান্ত – সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেমের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং স্বতন্ত্রভাবে তাদের কাজ যথাসম্ভব সম্পাদন করার ক্ষমতা। কেবল কোনো ব্যতিক্রম, হস্তক্ষেপ বা সাংঘর্ষিক লক্ষ্যের ক্ষেত্রে উচ্চস্তরে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।

আমাদের সমাজ এবং চলতি ট্রেন্ডগুলোকে গভীরভাবে দেখলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব অনেকগুলো উপাদানে ভাগ করা যায়। এই উপাদানগুলো কতটা ব্যাপক তা বুঝার জন্য উদাহরণস্বরূপ কিছু উল্লেখযোগ্য ডিজিটাল প্রযুক্তির নাম দেয়া হল:

  • মোবাইল ডিভাইস
  • ইন্টারনেট অফ থিংস (আইওটি) প্ল্যাটফর্ম
  • অবস্থান সনাক্তকরণ প্রযুক্তি (বৈদ্যুতিক সনাক্তকরণ)
  • উন্নত মানব-মেশিন ইন্টারফেস
  • প্রমাণীকরণ এবং জালিয়াতি সনাক্তকরণ
  • স্মার্ট সেন্সর
  • বিগ অ্যানালিটিকস এবং উন্নত প্রক্রিয়া
  • বহুস্তরীয় গ্রাহক ইন্টারঅ্যাকশন এবং গ্রাহক প্রোফাইলিং
  • অগমেন্টেড রিয়েলিটি / ওয়্যারেবল টেকনোলজি
  • চাহিদা সাপেক্ষে কম্পিউটার সিস্টেম রিসোর্সের প্রাপ্যতা
  • ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন এবং ট্রিগারড লাইভ ট্রেনিং

মূলত এই প্রযুক্তিগুলি চারটি প্রধান উপাদানে নিয়ে আসা যেতে পারে, যা “ইন্ডাস্ট্রি ৪.০” বা “স্মার্ট ফ্যাক্টরি” শব্দটিকে সংজ্ঞায়িত করে:

  • সাইবার-ফিজিক্যাল সিস্টেম
  • ইন্টারনেট অফ থিংস (আইওটি)
  • চাহিদা সাপেক্ষে কম্পিউটার সিস্টেম রিসোর্সের প্রাপ্যতা
  • কগনিটিভ কম্পিউটিং

ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ ব্যাপক আকারে নতুন প্রযুক্তির সংযোগ করে উপযোগ তৈরী করে। সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেম ব্যবহার করে বাস্তব জগতের ভার্চুয়াল অনুলিপি তৈরী করা সম্ভব। এই সিস্টেমের বৈশিষ্টগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল স্বাধীনভাবে ডিসেন্ট্রালাইজড ডিসিশান নেওয়ার ক্ষমতা।

ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ অনেকাংশেই বৈদ্যুতিন শনাক্তকরণের ওপর নির্ভর করতে পারে। সেক্ষেত্রে উৎপাদন পদ্বতিকে স্মার্ট করতে সেট টেকনোলজি স্থাপন করতে হবে। তাহলে আর ডিজিটাইজেশন এর প্রয়োজন হবে না। অন্যান্য শিল্প বিপ্লবের সাথে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রধান পার্থক্য হচ্ছে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্প বিপ্লব শুধুমাত্র মানুষের শারীরিক পরিশ্রমকে প্রতিস্থাপন করেছে; কিন্তু চতুর্থ শিল্প বিপ্লব শুধুমাত্র শারীরিক নয়, মানসিক পরিশ্রমকে প্রতিস্থাপন করবে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মূল প্রভাবক

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সামগ্রিক প্রভাব আমাদের জীবনে কতটা বিস্তৃত এবং গভীর হতে যাচ্ছে তা আমরা খুব সহজেই অনুধাবন করতে পারি যদি এর উদ্ভাবনগুলোর দিকে লক্ষ করি। যেমন-

রোবট :

ইতিমধ্যেই রোবটিকস দূর নিরাপত্তা, কারখানার বিপজ্জনক কাজ, স্থাপনার শ্রমিক, কিংবা স্রেফ নিরাপত্তা প্রহরী বা গৃহস্থালি কাজ করতে সক্ষম। রোবটিকস অটোমেশন বলতে বোঝায় কারখানার সবগুলো মেশিন এমন একটি সিস্টেমের সাথে যুক্ত থাকবে, যেটি স্বয়ংক্রিয় চালনা থেকে শুরু করে পুরো উৎপাদনপ্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান করবে। এতে বাঁচবে শ্রম খরচ, কমবে মানবিক ত্রুটি।

রোবটের বৈশিষ্ট্য :

১। রোবট সফটওয়্যার নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় সুনির্দিষ্ট কোন কাজ দ্রুত ও নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করতে পারে।

২। পূর্ব থেকে দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী রোবট কাজ করে।

৩। রোবট অবিরাম কাজ করতে পারে।

৪। রোবট যে কোন ঝুঁকিপূর্ণ বা অস্বাস্থ্যকর স্থানে কাজ করতে পারে।

৫। এটি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরতে বা স্থানান্তরিত হতে পারে।

৬। দূর থেকে লেজার রশ্মি বা রেডিও সিগন্যালের সাহায্যে রোবট নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

রোবটের উল্লেখযোগ্য ব্যবহারগুলো :

১। রোবটকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয় কম্পিউটার-এইডেড ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে, বিশেষ করে যানবাহন ও গাড়ি তৈরির কারখানায়।

২। স্বাভাবিকভাবে মানুষের জন্য বিপজ্জনক, যেমন- বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয়করণ, ডুবে যাওয়া জাহাজের অনুসন্ধান, খনি অভ্যন্তরের কাজ ইত্যাদি কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের বা বিপজ্জনক ও জটিল কাজগুলো রোবটের সাহায্যে করা যায়।

৩। কারখানায় কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত রোবটের সাহায্যে নানা রকম বিপজ্জনক ও পরিশ্রমসাধ্য কাজ করা হয়। যেমন- ওয়েল্ডিং, ঢালাই, ভারী মাল উঠানো বা নামানো, যন্ত্রাংশ সংযোজন করা ইত্যাদি।

৪। চিকিৎসাক্ষেত্রে রোবট সার্জনদের জটিল অপারেশনে ও নানা ধরনের কাজে সহায়তা করে থাকে।

৫। মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে রোবটের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। মহাকাশ অভিযানে এখন মানুষের পরিবর্তে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সংবলিত রোবট ব্যবহৃত হচ্ছে। (ফোর্ড, ২০১৬)

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা :

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে মেশিন ইন্টেলিজেন্সও বলা হয়। কম্পিটার সাইন্সের উৎকৃষ্টতম উদাহরণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রধানত যে চারটি কাজ করে তা হল- কথা শুনে চিনতে পারা, নতুন জিনিস শেখা, পরিকল্পনা করা এবং সমস্যার সমাধান করা। মূলত এইসব সুবিধাই যখন বিভিন্ন বস্তুতে যোগ করা হয় তখনই সেটা হয় ইন্টারনেট অব থিংস। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার ইতিমধ্যে সকল স্মার্টফোনেই প্রায় ব্যবহৃত হচ্ছে, যেমন- ভাল সেলফি তুলতে, গ্রাহকের অভ্যাস এবং প্রয়োজনীয়তা মনে রেখে কাস্টমাইজ সেবা দিতে। ধারণা করা হচ্ছে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের বিকল্প হিসাবে কাজ করবে। যার মানে স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে ফসল উৎপাদন, পণ্য উৎপাদন এবং ট্রান্সপোর্টেশনে আমূল পরিবর্তন চলে আসবে। মানুষের হাত ছাড়াই নিয়ন্ত্রিত হবে এসব খাত।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে উৎকর্ষ :

সুস্থতায় বংশগত রোগ কমাতে আসবে নীরোগ জিন, কঠিন অসুখের প্রতিষেধক। আর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অস্ত্রোপচার করতে ছুরি-কাঁচি ছাড়া কম্পিউটারের দক্ষ হাতের বহুল ব্যবহার শুরু হবে এই বিপ্লবে। মানুষ হয়ত অমর হবে না, কিন্তু পৌঁছে যাবে অমরত্বের কাছাকাছি!

ড্রোন :

ড্রোন হচ্ছে এক বিশেষ ধরনের মানবহীন পাখিসদৃশ যন্ত্রবিশেষ (আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকল), যাকে সংক্ষেপে ইউএভি বলা হয়। হেলিকপ্টার বা এজাতীয় অন্যান্য গগনচারী যানের সঙ্গে ড্রোনের মূল পার্থক্য হচ্ছে, হেলিকপ্টার বা এজাতীয় কোন যান চালানোর জন্য এক বা একাধিক মানুষের প্রয়োজন হলেও ড্রোন চালানোর জন্য কোন মানুষের দরকার হয় না। দূর থেকেই তারহীন নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার মাধ্যমে অথবা আগে থেকে নির্ধারিত প্রোগ্রামিং দ্বারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ড্রোন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বর্তমানে গুগল, অ্যামাজনের মত বড় বড় কোম্পানি পণ্য পরিবহন, যোগাযোগ রক্ষা, তথ্য পরিবহনসহ নানা কাজে সার্থকতার সঙ্গে ড্রোন কাজে লাগাচ্ছে। ফেসবুক আজ ড্রোনের মাধ্যমে পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ‘ইন্টারনেট সেবা’ পৌঁছে দিচ্ছে। মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায়ও আজকাল ড্রোন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। (পাইক, ২০২৪)

কল্পবাস্তবতা বা ভার্চুয়াল রিয়ালিটি :

প্রকৃত অর্থে বাস্তব নয় কিন্তু বাস্তবের চেতনার উদ্যোগকারী বিজ্ঞাননির্ভর কল্পনাকে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি বা অনুভবের বাস্তবতা কিংবা কল্পবাস্তবতা বলে। ভার্চুয়াল রিয়ালিটি হচ্ছে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত সিস্টেম, যাতে মডেলিং ও অনুকরণবিদ্যা প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষ কৃত্রিম ত্রিমাত্রিক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পরিবেশের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন বা উপলব্ধি করতে পারে।

প্রাত্যহিক জীবনে ভার্চুয়াল রিয়ালিটির ব্যবহার :

১. উন্নত বিশ্বে ডাক্তারদের আধুনিক মানের প্রশিক্ষণ প্রদানে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীরা কৌশলগত দক্ষতা, অপারেশন ও রোগ সম্পর্কিত তাত্ত্বিক বিষয়াদির কার্যপ্রণালী অনুশীলন করতে সক্ষম হন।

২. ভার্চুয়াল রিয়ালিটির মাধ্যমে ভার্চুয়ালি ড্রাইভিং ও ড্রাইভিংয়ের নানা নিয়ম-কানুন খুব সহজেই এর ফলে আয়ত্ত করা সম্ভব।

৩. উন্নত বিশ্বের বাণিজ্যিক বিমান সংস্থা কিংবা সামরিক বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে বিমান পরিচালনা প্রশিক্ষণে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি ব্যবহার করছে। ভার্চুয়াল রিয়ালিটি কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে ফ্লাইট সিমুলেশনের ক্ষেত্রে স্বল্প খরচে বিমানচালকের প্রশিক্ষণ প্রদান করা সম্ভব হয়।

৪. বিভিন্ন ধরনের সামরিক প্রশিক্ষণে ভার্চুয়াল রিয়ালিটিকে গুরুত্বের সাথে ব্যবহার করা হয়।

৫. ব্যবসা-বাণিজ্যে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি ব্যবহার করে তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও সহজ করা হয়েছে।

৬. সবাই জানে মহাশূন্য অভিযানের প্রতিটি পর্বেই রয়েছে নানা ধরনের ঝুঁকি, তাই প্রস্তুতিপর্বের নানা গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নভোচারীদের কার্যক্রম, নভোযান পরিচালনা সম্পর্কিত যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে প্রশিক্ষণে তাই ভার্চুয়াল রিয়ালিটি বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। (খানসামা, ২০২৪)

বর্ধিত বাস্তবতা বা অগমেন্টেড রিয়ালিটি :

অগমেন্টেড রিয়ালিটি হলো এমন এক প্রযুক্তি, যাকে বাস্তব জগতের এক বর্ধিত সংস্করণ বলা যেতে পারে। আপনি বাস্তবে যা দেখবেন, তার ওপর কম্পিউটার নির্মিত একটি স্তর যুক্ত করে দেবে অগমেন্টেড রিয়ালিটি। অচেনা কোন এক স্থানে ঘুরতে গেলেন গাড়িতে করে। আপনি ড্রাইভ করার সময় চোখের ইশারাতেই আপনার সামনে ভেসে উঠছে রাস্তা কিংবা আশপাশের বিভিন্ন তথ্য।

কখনও কখনও আপনি চাইলেই ইশারায় শুনে নিতে পারছেন দরকারি বিভিন্ন নির্দেশনা, যেমন- আজকের দিনের সম্ভাব্য আবহাওয়ার তথ্য। রাস্তায় জ্যাম থাকলে আপনার সামনে চলে আসছে শর্টকাট পথের নেভিগেশন, যা আপনার জন্য নিরাপদ ও সময়সাশ্রয়ী। কিংবা যাবার পথে খাবার জন্য হোটেল খুঁজছেন? রাস্তা দিয়ে যাবার সময়ই আপনি আপনার স্মার্টফোনটি বিল্ডিংগুলোর দিকে তাক করাতেই সেগুলোর ট্যাগ আপনার ফোনে স্ক্রিনে উঠে বলে দিচ্ছে, কোন বিল্ডিংটি কিসের আর সেটির কোন বিখ্যাত ইতিহাস আছে কি না। সাথে সাথে আপনি জেনে নিতে পারছেন আশপাশে কোন হোটেল থাকলে। (আরাফাত, ২০২৪)

ত্রিমাত্রিক মুদ্রণ বা থ্রিডি প্রিন্টিং :

এটি এমন একটি ডিভাইস, যা যে কোন বাস্তব বস্তুর ত্রিমাত্রিক অনুলিপি বা রেপ্লিকা তৈরি করতে সক্ষম। সাধারণ প্রিন্টার থেকে এর পার্থক্য হচ্ছে, সাধারণ প্রিন্টারে আপনি একটি ছবি তুলে সেটি একটি কাগজের টুডি সারফেসে প্রিন্ট করে আনতে পারবেন, কিন্তু থ্রিডি প্রিন্টার আপনাকে সেই ছবিটির বাস্তব রূপটিই বের করে দেবে! একটি সম্পূর্ণ থ্রিডি প্রিন্টাররের তিনটি অংশ রয়েছে- মেশিন প্রোপার, কম্পিউটার এবং ত্রিমাত্রিক ছবি তোলার জন্য একটি ক্যামেরা বা স্ক্যানার।

যে বস্তুটিকে প্রিন্ট করা হবে, প্রথমে স্ক্যানারের সাহায্যে তার একটি ত্রিমাত্রিক ছবি তোলা হয়, বস্তুটির সব দিক ঘুরিয়ে সব খুঁটিনাটি অংশ ক্যামেরায় ধরা পড়ে। এবার এই ইমেজটিকে কম্পিউটারে প্রসেস করা হয়। কম্পিউটারে চাইলে ইচ্ছামত এডিটও করা যায়, যেমন- আকার পরিবর্তন, কোন অংশ বাদ দেয়া বা সংযোজন বা রঙ পরিবর্তন ইত্যাদি। এবার প্রসেসিং শেষে প্রিন্ট দিলেই মেশিন প্রোপারে রাখা ম্যাটেরিয়ালের সাহায্যে বস্তুটির একটি বাস্তব রেপ্লিকা তৈরি হয়ে যায়!

অর্থাৎ যদি কোন মানুষের ত্রিমাত্রিক ছবি তোলা হয় তবে এই প্রিন্টার তার একটি ত্রিমাত্রিক কপি তৈরি করে দেবে কয়েক মিনিটের মধ্যেই! এই যন্ত্র দ্বারা কিডনি থেকে শুরু করে বন্দুক, গাড়ি, কৃত্রিম হাত-পা সংযোজন, শিল্পকর্মের প্রতিরূপ (রেপ্লিকা) তৈরির মতো কাজে থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তির ব্যবহারে আগামী কয়েক দশকে আমাদের জীবনযাত্রায় অভাবনীয় পরিবর্তন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। (ফয়সাল, ২০১৩)

ইন্টারনেট অব থিংস :

ইন্টারনেট অব থিংসকে সংক্ষেপে আইওটি বলে, যার বাংলা অর্থ হল বিভিন্ন জিনিসের সাথে ইন্টারনেটের সংযোগ। আমাদের চারপাশের সকল বস্তু যখন নিজেদের মধ্যে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ করবে এবং নেটওয়ার্ক গড়ে তুলবে, সেটাই হবে ইন্টারনেট অব থিংস। ইতিমধ্যে আমরা গুগল হোম, অ্যামাজনের আলেক্সার কথা শুনেছি, যা আপনার ঘরের বাতি, সাউন্ড সিস্টেম, দরজাসহ অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে।

এই প্রযুক্তির মাধ্যমে আপনার বাসার চুলাকে আপনি একবার শিখিয়ে দেবেন কখন কী খেতে পছন্দ করেন। ধরুন বৃষ্টির দিনে আপনি খিচুড়ি ভালোবাসেন, আপনার চুলা সেটা মনে রাখবে এবং বাইরে বৃষ্টি পড়লে সেদিন আপনার জন্য খিচুড়ি রান্না করে রাখবে। আপনি সকালে ডিম-রুটি খাবেন, সেটাও সে প্রতিদিন করে দেবে অথবা সপ্তাহের একেক দিন তাকে একেক রেসিপি রাঁধতে বলবেন, সে তাই করবে। বাড়ির দরজা দিয়ে যখন বেরিয়ে যাবেন আপনাকে দরজা লাগাতে হবে না, আপনি বাড়িতে নেই জেনে দরজাটি আর খুলবে না, আবার আপনি এসে যখন দরজার সামনে দাঁড়াবেন, আপনার চোখ, হাত, পা, শরীর দেখেই আপনাকে চিনে নিজে নিজেই খুলে যাবে। আপনার চোখের চশমা কিংবা কানের হেডফোনই আপনাকে রাস্তা দেখাবে আর সব তথ্য দিয়ে দেবে।

ব্লকচেইন প্রযুক্তি :

ব্লকচেইন হচ্ছে তথ্য সংরক্ষণ করার একটি নিরাপদ ও উন্মুক্ত পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে তথ্য বিভিন্ন ব্লকে একটির পর একটি চেইন আকারে সংরক্ষণ করা হয়। এটি একটি অপরিবর্তনযোগ্য ডিজিটাল লেনদেন, যা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক লেনদেনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে কোন কার্য-পরিচালনা রেকর্ড করা যেতে পারে; যার ফলে বিশ্বজুড়ে এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ব্লকচেইন প্রযুক্তি। ব্লকচেইনকে আধুনিককালের এক অভিনব উদ্ভাবন বলা হচ্ছে। ‘সাতোশি নাকামতো’ ছদ্মনামের এক বা একাধিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এ প্রযুক্তির উদ্ভাবক।

২০০৯ সালে প্রথমবারের মত বিটকয়েন সফটওয়্যার প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে ব্লকচেইন প্রযুক্তির অনেক বিবর্তন ঘটে চলেছে। তথ্যকে ডিজিটালরূপে বণ্টন করে (অনুলিপি নয়) এই ব্লকচেইন প্রযুক্তি এক নতুন ধরনের ইন্টারনেট সৃষ্টি করেছে। কেবল ডিজিটাল মুদ্রা বিটকয়েনের জন্য ব্লকচেইনের উদ্ভাবন করা হলেও এখন প্রযুক্তির নানা ক্ষেত্রে এর সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। ব্লকচেইন প্রযুক্তি বিকেন্দ্রিত হওয়ায় অনেক অনুক্রমিক কাজ একসঙ্গে হয়ে যায়। যেমন- এ প্রযুক্তি ব্যবহারে শেয়ারবাজারের লেনদেন যুগপৎভাবে হতে পারে; কিংবা ভূমি নিবন্ধন রেকর্ডকে জনসাধারণের জন্য অনেক সহজলভ্য করা যেতে পারে। বাংলাদেশেরও ব্লকচেইন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার সময় এসে গেছে বলে অনেকে বলছেন। (কবির, ২০২৪)

ক্লাউড কম্পিউটিং :

ক্লাউড কম্পিউটিং এমন একটি প্রযুক্তি, যার ফলে আপনার কম্পিউটারের হার্ডডিস্কের ওপর আর চাপ থাকছে না। যে কোন স্টোরেজ, সফটওয়্যার এবং যাবতীয় অপারেটিং সিস্টেমের কাজ চলে যাচ্ছে হার্ডডিস্কের বাইরে। শুধু ইন্টারনেট থাকলেই ক্লাউড সার্ভারে কানেক্ট হয়েই সব সুবিধা নেয়া যাবে। কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক নষ্ট হওয়া বা সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও ক্লাউড সার্ভার ডাউন হওয়ার সুযোগ নেই। যেহেতু এতে আলাদা কোন সফটওয়্যার কেনার প্রয়োজন হয় না বা কোন হার্ডওয়্যারের প্রয়োজন হয় না, তাই স্বাভাবিকভাবেই খরচ কম। ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের কাজগুলো যে কোন স্থানে বসেই মোবাইলের মাধ্যমে কন্ট্রোল করা যায় এবং কম্পিউটিংয়ের সফটওয়্যারগুলো আপডেট করার প্রয়োজন নেই। এগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপডেট হয়ে থাকে।

ঙ) ভবিষ্যত সমাজকর্মীর করনীয়

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আমাদের জীবনযাত্রা, কাজ করার এবং একের সঙ্গে অপরের সম্পর্কিত হওয়ার মৌলিক পদ্ধতিগুলো আমূল পরিবর্তন করে দেবে। শিল্প উৎপাদনগত দিক থেকে এটি মানব বিকাশের একটি নতুন অধ্যায়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্পবিপ্লবগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে এটা শারীরিক, ডিজিটাল এবং জৈবিক জগৎকে এমনভাবে একাকার করবে, যা নতুন সম্ভাবনার পাশাপাশি অনিয়ন্ত্রিত ভয়াবহ বিপদেরও জন্ম দিতে পারে। ফলে বিপ্লবের গতি, পরিসর এবং গভীরতা ঠিক কীভাবে বিকশিত করা উচিত, তা নিয়ে বিশ্বের দেশগুলো ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে ব্যাপক অন্তর্ভুক্তিমূলক সংলাপ জরুরি।

নতুন প্রযুক্তিগুলোর কাজ কীভাবে মানবিক মূল্যবোধকে শ্রদ্ধা করবে, জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ সমুন্নত রাখবে এবং রাষ্ট্রে, সমাজে ও ব্যবসায়ে মানবিকতা, দেশে দেশে ধর্মীয় মূল্যবোধের সহনশীলতা বজায় রাখার পাশাপাশি নতুন মূল্যবোধ তৈরি করবে, তার পর্যালোচনাও চলছে বিশ্বজুড়ে। এমনকি মানুষ হওয়ার অর্থ ভবিষ্যতে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হবে; সে বিষয়ে বোঝাপড়াও দরকার। এ অবস্থায় একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, মানবিককেন্দ্রিক ভবিষ্যৎ তৈরির জন্য বাংলাদেশ সরকার, শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের সবাইকে কাজ করতে হবে।

ভবিষ্যত করনীয়দের কে নিচের প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে হবেঃ

ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতাসমূহ:

  • অর্থনৈতিক সম্পাদনা
  • উচ্চ ব্যয়
  • উপযুক্ত ব্যবসায়িক মডেলের সাথে খাপ খাওয়ানো
  • অস্পষ্ট অর্থনৈতিক সুবিধা / অতিরিক্ত বিনিয়োগ
  • সামাজিক সম্পাদনা
  • ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিষয়ক উদ্বেগ
  • নজরদারি এবং অবিশ্বাস
  • অংশীদারদের পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়ার অনীহা
  • কর্পোরেট আইটি ডিপার্টমেন্টের অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ার আশঙ্কা
  • সামাজিক বৈষম্য এবং অস্থিরতা বৃদ্বি
  • স্বয়ংক্রিয় এবং আইটি নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়ার জন্য বিশেষত শ্রমিকদের চাকরি হারানো
  • রাজনৈতিক সম্পাদনা
  • ব্যবস্থাপনা, মানদন্ড এবং সার্টিফিকেশন ফর্মের অভাব
  • জনসাধারণ বিশেষত বিরোধিতাকারীদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের সম্ভাব্যতা
  • অস্পষ্ট আইনি ব্যবস্থা এবং ডেটা সুরক্ষা
  • সাংগঠনিক সম্পাদনা
  • আইটি সুরক্ষাজনিত সমস্যা, যেগুলো পূর্বে বন্ধ থাকা দোকান পুনরায় চালু করার সহজাত প্রয়োজনের জন্য ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে
  • জটিল মেশিন টু মেশিন ( এমটুএম) যোগাযোগ স্থাপন, স্বল্প ও স্থিতিশীল বিলম্ব কাল রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় নির্ভরশীলতা ও স্থিতিশীলতা
  • উৎপাদন প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে অখন্ডতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা
  • যেকোনো ধরনের তথ্য প্রযুক্তিগত বাধা এড়িয়ে চলা কেননা এগুলো উৎপাদনে ব্যয়বহুল বিভ্রাট ঘটায়
  • চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে দ্রুত রূপান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রিক দক্ষতার অভাব
  • শীর্ষ পরিচালকবর্গের নিবেদনের অভাব
  • কর্মীদের অপর্যাপ্ত যোগ্যতা

এটিই তোমাদের এইচএসসি পরীক্ষা ২০২৪ পঞ্চম সপ্তাহের সমাজকর্ম ১ম পত্র বিষয়ের অ্যাসাইনমেন্ট এর বাছাইকরা উত্তর- শিল্প বিপ্লবের ফলে সমাজকর্ম পেশার উত্থান এবং বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মুখােমুখি- ভবিষ্যৎ সমাজকর্মী হিসাবে করণীয় নির্ধারণ

I hope you are enjoying this article. Thanks for visiting this website.