Language movement

২০২৪ সালের মানবিক বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী বন্ধুরা, তোমাদের জন্য এইচএসসি পরীক্ষা ২০২৪ পঞ্চম সপ্তাহের পৌরনীতি ও সুশাসন ২য় পত্র বিষয়ের অ্যাসাইনমেন্ট এর বাছাইকরা উত্তর- বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব মূল্যায়ন নিয়ে আজকে হাজির হলাম।

এই আলোচনা সঠিকভাবে অনুশীলনের মাধ্যমে তোমরা দেশের সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য ২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষার পঞ্চম সপ্তাহের মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রদানকৃত পৌরনীতি ও সুশাসন ২য় পত্র অ্যাসাইনমেন্ট এর সমাধান/ উত্তর খুব ভালো ভাবে সম্পন্ন করতে পারবে।

আমরা এইচএসসি পরীক্ষা ২০২৪ এর পৌরনীতি ও সুশাসন ২য় পত্র এসাইনমেন্টের দেওয়া নির্দেশনা সমূহ যথাযথভাবে অনুসরণ করে প্রশ্নে উল্লেখিত নির্দেশনাসমূহ ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করব যাতে তোমাদের অ্যাসাইনমেন্ট লিখতে সুবিধা হয়।

এইচএসসি ২০২৪ ৫ম সপ্তাহের পৌরনীতি ও সুশাসন ২য় পত্র অ্যাসাইনমেন্ট

https://i.imgur.com/Uv7Is0F.jpg

এইচএসসি ২০২৪ ৫ম সপ্তাহের পৌরনীতি ও সুশাসন ২য় পত্র অ্যাসাইনমেন্ট

অ্যাসাইনমেন্ট : বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব মূল্যায়ন।

নির্দেশনা (সংকেত/ধাপ/পরিধি):

  • ভাষা আন্দোলন, ৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন;
  • ৬ দফার গুরুত্ব, আগরতলা মামলা;
  • ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন, অসহযােগ আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু;

এইচএসসি পরীক্ষা ২০২৪ ৫ম সপ্তাহের পৌরনীতি ও সুশাসন ২য় পত্র বিষয়ের অ্যাসাইনমেন্ট উত্তর

ক) ভাষা আন্দোলন, ৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান অধিরাজ্য ও ভারত অধিরাজ্য নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। পাকিস্তানের ছিল দুইটি অংশ: পূর্ব বাংলা (১৯৫৫ সালে পুনর্নামাঙ্কিত পূর্ব পাকিস্তান) ও পশ্চিম পাকিস্তান। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের অধিক দূরত্বের ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান ছিল। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান অধিরাজ্য সরকার ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।

কার্যত পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব মূল্যায়ন

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে রফিক, সালাম, এম. এ. ক্লাসের ছাত্র বরকত ও আব্দুল জব্বারসহ আরও অনেকে। এছাড়া ১৭ জন ছাত্র-যুবক আহত হয়। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে এবং সভা-শোভাযাত্রাসহকারে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান শফিক, রিক্সাচালক আউয়াল এবং অলিউল্লাহ নামক এক কিশোর। ২৩ ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্র-জনতার মিছিলেও পুলিশ অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। এ নির্লজ্জ, পাশবিক, পুলিশি হামলার প্রতিবাদে মুসলিম লীগ সংসদীয় দল থেকে সেদিনই পদত্যাগ করেন। ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে রাতারাতি ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে শহীদ মিনার, যা ২৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা।

আন্দোলনের সূচনাঃ

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের (পূর্ব বাংলা হিসেবেও পরিচিত) বাংলাভাষী ৪ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ ৬ কোটি ৯০ লাখ জনসংখ্যাবিশিষ্ট নবগঠিত পাকিস্তানের নাগরিকে পরিণত হয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার, প্রশাসন এবং সামরিক বাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। ১৯৪৭ সালে করাচীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাপত্রে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহারের সুপারিশসহ প্রচারমাধ্যম ও বিদ্যালয়ে কেবলমাত্র উর্দু ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। ওই সমাবেশে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের প্রবল দাবি উত্থাপন করা হয়।

কিন্তু পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন বাংলাকে তাদের অনুমোদিত বিষয়তালিকা থেকে বাদ দেয় ও সাথে সাথে মুদ্রা এবং ডাকটিকেট থেকেও বাংলা অক্ষর বিলুপ্ত করে। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান মালিক উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বানানোর জন্যে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।

পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং ১৯৪৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্রদের একটি বিশাল সমাবেশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্ররা ঢাকায় মিছিল এবং সমাবেশের আয়োজন করে।

নেতৃস্থানীয় বাঙালি পণ্ডিতগণ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার বিপক্ষে মত দেন। পাকিস্তানের কোনো অংশেই উর্দু স্থানীয় ভাষা ছিল না বলে উল্লেখ করেছেন ভাষাবিদ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি বলেন যে, “আমাদের যদি একটি দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ করার প্রয়োজন হয়, তবে আমরা উর্দুর কথা বিবেচনা করতে পারি।” সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমেদ বলেছেন যে, উর্দুকে যদি রাষ্ট্রভাষা করা হয় তবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ ‘নিরক্ষর’ এবং সকল সরকারি পদের ক্ষেত্রেই ‘অনুপযুক্ত’ হয়ে পড়বে। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সমর্থনে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। তমদ্দুন মজলিশের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। পরবর্তীতে সংসদ সদস্য সামসুল হক আহ্বায়ক হয়ে নতুন কমিটি গঠন করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে কার্যক্রম আরও জোরদার করেন।

ভাষা আন্দোলনের পুনর্জাগরণঃ

ভাষা আন্দোলনের মতো আবেগিক বিষয়ের পুনরায় জোরালো হবার পেছনে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিনের ভাষণ প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন খাজা নাজিমুদ্দিন ২৫ জানুয়ারি ঢাকায় আসেন এবং ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের এক জনসভায় দীর্ঘ ভাষণ দেন। তিনি মূলত জিন্নাহ্’র কথারই পুনরুক্তি করে বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচারিত তার ভাষণে তিনি আরো উল্লেখ করেন যে কোনো জাতি দু’টি রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারেনি। নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৯ জানুয়ারি প্রতিবাদ সভা এবং ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। সেদিন ছাত্রসহ নেতৃবৃন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেত হয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।

পরে তারা তাদের মিছিল নিয়ে বর্ধমান হাউসের (বর্তমান বাংলা একাডেমী) দিকে অগ্রসর হয়। পরদিন ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত সভায় মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ৪০ সদস্যের সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ গঠিত হয়। সভায় আরবি লিপিতে বাংলা লেখার সরকারি প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করা হয় এবং ৩০ জানুয়ারির সভায় গৃহীত ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন দেয়া হয়। পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল, সমাবেশ ও মিছিলের বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে।

পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে সমবেত হয়। সমাবেশ থেকে আরবি লিপিতে বাংলা লেখার প্রস্তাবের প্রতিবাদ এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবি জানানো হয়। ছাত্ররা তাদের সমাবেশ শেষে এক বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের করে।

২০ ফেব্রুয়ারি সরকার স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় এক মাসের জন্য সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিভিন্ন হলে সভা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ৯৪ নবাবপুর রোডস্থ আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরিষদের কিছু সদস্য নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার পক্ষে থাকলেও, সবশেষে ১১-৩ ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে একই বিষয় নিয়ে পৃথক পৃথক সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সন্ধ্যায় সলিমুল্লাহ হলে ফকির শাহাবুদ্দীনের সভাপতিত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফজলুল হক মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত সভায় নেতৃত্ব দেন আবদুল মোমিন। শাহাবুদ্দিন আহমদের প্রস্তাব অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে এই সিদ্ধান্তটি জানিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নেন আবদুল মোমিন এবং শামসুল আলম।

২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনাঃ

পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী এ দিন সকাল ৯টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হয়। তারা ১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে স্লোগান দিতে থাকে এবং পূর্ব বঙ্গ আইন পরিষদের সদস্যদের ভাষা সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মতামতকে বিবেচনা করার আহ্বান জানাতে থাকে। পুলিশ অস্ত্র হাতে সভাস্থলের চারদিক ঘিরে রাখে। বিভিন্ন অনুষদের ডীন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঐসময় উপস্থিত ছিলেন।

বেলা সোয়া এগারটার দিকে ছাত্ররা গেটে জড়ো হয়ে প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে ছাত্রদের সতর্ক করে দেয়। কিছু ছাত্র ঐসময়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দিকে দৌঁড়ে চলে গেলেও বাদ-বাকিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং পুলিশের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। উপাচার্য তখন পুলিশকে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ বন্ধ করতে অনুরোধ জানান এবং ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগের নির্দেশ দেন। কিন্তু ছাত্ররা ক্যাম্পাস ত্যাগ করার সময় কয়েকজনকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার শুরু করলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করে তেজগাঁও নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। এ ঘটনায় ছাত্ররা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে পুনরায় তাদের বিক্ষোভ শুরু করে।

উদযাপন

১৯৫৩ সাল থেকে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ দিন প্রত্যুষে সর্বস্তরের মানুষ খালি পায়ে প্রভাতফেরীতে অংশগ্রহণ করে এবং শহীদ মিনারে গিয়ে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন ও পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে। সারাদিন মানুষ শোকের চিহ্নস্বরূপ কালো ব্যাজ ধারণ করে। এছাড়া আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি তর্পণ করা হয় এবং ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করা হয়।

১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে দিনটি কখনো জাতীয় শোক দিবস, কখনো বা জাতীয় শহীদ দিবস হিসাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপিত হয়ে আসছে। ২০০১ সাল থেকে দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে। বাংলাদেশে এদিনে সরকারি ছুটি। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরা হয়। দৈনিক সংবাদপত্রসমূহে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়। বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হয় পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে। বাংলাদেশ সরকার বাংলা ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একুশে পদক প্রদান করে।

যুক্তফ্রন্ট গঠন, নির্বাচন ও প্রধান ইস্যু রাষ্ট্রভাষা বাংলাঃ

১৯৫৩ সালে মাতৃভাষার দাবিতে আন্দোলন আবার চাঙ্গা হতে থাকে। সেই সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকারের আর্থ সামাজিক শোষণ, বৈষম্যের বিরুদ্ধেও জনগণ ক্ষুব্ধ হয়। শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার জনগণের আশা আকাংখা পূরণে আবারও এগিয়ে আসেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের ৩ৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের অসুস্থতার কারণে দল সেই গুরু দায়িত্ব মুজিবের ওপর অর্পণ করে নিশ্চিন্ত হয়। ১৯৫৩ সালে মুজিব আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করে ভাষা আন্দোলনসহ অন্যান্য আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন।

তৎকালীন পূর্ব বাংলার সর্ববৃহৎ দল আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদকের মত বিশাল দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে শেখ মুজিব বাংলার মানুষের আশা-আকাংক্ষা পূরণে ব্রতী হন। দলের একজন শীর্ষ নেতা হয়েও শেখ মুজিব নিজেকে কখনই নেতা হিসেবে মূল্যায়ন করতেন না, বরং নিজেকে সব সময় একজন কর্মী/সেবক ভাবতেন। সে সময় মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক নেতৃত্ব যখন ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ ও পূর্ব বাংলার জনগণকে শোষণের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্ম কৌশল নিয়ে বিতর্ক (বিটি রণদীভে ও পিসি যোশী বিতর্ক) নিয়ে ব্যস্ত ৩খন শেখ মুজিব বাংলার মানুষের দ্বারে দ্বারে ফিরছেন, তাদের দুঃখ দুর্দশা, অভিযোগ শুনছেন স্বীয় অধিকার, দাবী দাওয়া সম্পর্কে তাদের সচেতন করে তুলছেন, আন্দোলনে শরীক হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন।

মোটকথা, শেখ মুজিবের রাজনীতির মূল বিষয়ই ছিল সাধারণ মানুষ, মানুষের স্বপ্ন আশা আকাংক্ষা পূরণ । তাই খুব আল্প দিনের মধোই শেখ মুজিব শুধু আওয়ামী মুসলিম লীগেরই নয় সারা বাংলার একজন জনপ্রিয় নেতাতে পরিণত হন। এসময় ফজলুল হক সাহেব কৃষক শ্রমিক পার্টি নামে একটি দল গঠন করে সরকার বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। গণতন্ত্রের পূজারী, অখণ্ড বাংলা আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যিনি পূর্বেই আওয়ামী মুসলিম লীগের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন, তিনিও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলায় ফিরে এসে আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব মূল্যায়ন

এসময় পাকিস্তান সরকার ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলায় সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দিলে বাংলার ছাত্র জনতা হক ভাসানী সোহরাওয়াদীকে একই মঞ্চে আসার দাবি উত্থাপন করে। পূর্ব বাংলার শোষিত বঞ্চি৩ ছাত্র জনতার দাবি গ্রাহ্য হয়। ফলশ্রুতিতেই ১৯৫৩ সালের ৪ লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, গণতন্ত্রী দল ও নেজামে ইসলামকে নিয়ে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট যুক্তফ্রন্ট রক্তম্বাত ২১ ফেব্রুয়ারিকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য নির্বাচনী দাবি দাওয়াকে ২১ টি দফার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে এবং প্রথম দফায় মায়ের ভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উদযাপন করে। ২১ দফার মধ্যে ছিল:

১. বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা;

২. বিনা খেসারতে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ ও সকল প্রকার মধ্যস্বত্বের বিলোপ সাধন, ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বণ্টন; ভূমি রাজস্বকে ন্যায়ঙ্গতভাবে হ্রাস করা এবং সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল করা;

৩. পাট ব্যবসা জাতীয়করণ, পাট উৎপাদনকারীদের পাটের ন্যায্য মূল্য প্রদানের ব্যবস্থা, মুসলিম লীগ শাস্তি প্রদান এবং তাদের অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা;

৪. সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা; কুটির শিল্পের বিকাশ ও শ্রমজীবীদের অবস্থার উন্নয়ন সাধন করা’

৫. পূর্ব বাংলাকে লবণের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে কুটির ও বৃহৎ পর্যায়ে লবণ শিল্প প্রতিষ্ঠা করা;

৬. অবিলম্বে বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন করা;

৭. সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং দেশকে বন্যা ও দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রক্ষা করা;

৮. পূর্ব বাংলাকে শিল্পায়িত করা এবং আই.এল.ও কনভেনশন অনুযায়ী শিল্প শ্রমিকদের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা;

৯. অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন ও শিক্ষকদের জন্য ন্যায্য বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা;

১০. সরকারী ও বেসরকারী বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বিভেদ বিলোপ করে সমগ্র মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন করা;

১১. বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত সকল প্রতিক্রিয়াশীল কলাকানুন বাতিল করে তাকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা;

১২. প্রশাসনিক ব্যয় সংকোচ করা এবং উচ্চ ও নিম্ন বেতনভোগী সরকারী কর্মচারীদের বেতনের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা; যুক্তফ্রন্টের কোন মন্ত্রী এক হাজারের বেশি বেতন গ্রহণ না করা”

১৩. দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি ও ঘুষ উচ্ছেদের লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালের পর থেকে সকল সরকারী কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী কর্তৃক অর্জিত সম্পত্তির হিসেব গ্রহণ করা এবং সকল অবৈধ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা;

১৪. নিরাপত্তা আইন বলে আটককৃত সকল নিরাপত্তা বন্দীকে মুক্তিদান এবং সমিতি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা;

১৫. শাসন বিভাগ হতে বিচার বিভাগ পৃথক করা;

১৬. বর্ধমান হাউস’ আপাতত ছাত্রাবাস এবং পরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণাগার করা;

১৭. বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য যারা প্রাণ উৎসর্গ মিনার নির্মাণ করা;

১৮. একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ঘোষণা ও তাকে সরকারী ছুটির দিন হিসেবে পালন করা;

১৯. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত আর সব বিষয় পূর্ববঙ্গ সরকারের হাতে অর্পণ, সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর পশ্চিম পাকিস্তানে রেখে নৌবাহিনীর সদর দপ্তর পূর্ব বাংলায় স্থানান্তর প্রতিরক্ষার ব্যাপারে পূর্ব বাংলাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য এখানে বস্ত্র কারখানা স্থাপন এবং আনসার বাহিনীকে পূর্ণাঙ্গ মিলিশিয়া হিসেবে গড়ে তোলা;

২০. যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা কোন অজুহাতেই আইনসভার আয়ু বৃদ্ধি করবে না, সাধারণ নির্বাচনের হয় মাস পূর্ব মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করবে এবং নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে।

২১. আইনসভার কোন আসন শূন্য হবার তিন মাসের মধ্যে উপনির্বাচনের মাধ্যমে তা পুরণ করা হবে এবং যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীরা পরপর তিনটি উপনির্বাচনে পরাজিত হলে মন্ত্রিসভা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবে।

সরকার বিরোধী দলগুলোকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন ও ২১ ফেব্রুয়ারিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ২১ দফা কর্মসূচী ঘোষিত হওয়ায় সারা বাংলায় ছাত্র-জনতার মধ্যে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। সরকারের অব্যাহত দমন নির্ধাতন উপেক্ষা করে ছাত্র জনতা সারা দেশে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান ও শহীদ দিবস পালন করে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ধ্বনিতে সারা দেশ যেন আবার মুখরিত হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ তোয়াহা বলেন, ১৯৫৩ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল বেশ সাংঘাতিক আন্দোলন; ‘৫৪ সালে এ আন্দোলন আরো ভয়ানক হয়ে উঠেছিল।

এদিকে যুক্তফ্রন্টের একজন অন্যতম নেতা হিসেবে শেখ মুজিব এই ২১ দফা দাবি নিয়ে প্রদেশের একপ্রান্ত হতে অপর প্রান্ত চষে বেড়ান। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা. একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও ছুটির দিন ঘোষণা, অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনসহ ২১ দফার সমর্থনে তিনি বড় বড় জনসভায় যে গুরুত্বপূর্ণ ও জনগণের অকুণ্ঠ ভালবাসা ও সমর্থন।

এই নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মুসলিম লীগ প্রার্থী ওয়াহিদুজ্জামানকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে টুঙ্গিপাড়া এলাকা থেকে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে জয়ী হয় এবং মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে। মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসন লাভ করে।

যুক্তফ্রন্টের এই বিজয়ের পিছনে কাজ করেছিল ২১ দফা কর্মসূচী যা অন্যতম প্রধান দফা ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার জনগণের মনে মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ, ঘৃণার সঞ্চার হয়েছিল, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের ফলাফলে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

যাই হোক নির্বাচনের পরপরই যুক্তফ্রল্টের বিরুদ্ধে আবার ঘড়যন্ত্র শুরু হয়। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের গভর্নর চৌধুরী খালেকুজ্জামান যিনি ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের হায়দ্রাবাদ সম্মেলনে উদ্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি যুক্তফ্রন্টের সর্ববৃহৎ দল আওয়ামী মুসলিম লীগকে বাদ দিয়ে কে এস পি নেতা ফজলুল হক সাহেবকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দান করলে আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

শেখ মুজিব চৌধুরী খালেকুজ্জামানের এমন আচরণে বিস্মিত হন এবং এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ যুক্তফ্রন্টের এ বিজয় সহজে মেনে নেবে না। ভবিষ্যতে তারা বার বার আঘাত হানতে থাকবে। তা সত্তেও তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে হক সাহেবকে মেনে নেন এবং ক্ষমতার বাইরে থেকেই দেশ ও জাতির সেবাই নিজেকে নিয়োজিত করেন। উল্লেখ্য যে ১৯৫৪ সালের এই নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৪৩টি এবং কেএসপি মাত্র ৪৮টি আসন লাভ করে। পরবর্তীতে অবশ্য পারিপার্থিকতার চাপে মুখ্যমন্ত্রী যে ১০ জন মন্ত্রি নিয়োগ করেন তার মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান হক মন্ত্রিসভায় যোগদান করেন। তিনি কৃষি, বন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন।

এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা, ভাষা আন্দোলনের অগ্রনায়ক ও দক্ষ সংগঠক, আওয়ামী মুসলিম লীগের সুযোগ্য সাধারণ সম্পাদক ও পূর্ব বাংলার জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতা এরপর হলেন দেশসেবক, মন্ত্রী। কিন্তু প্রথমেই হোচট খেলেন। কেন্দ্রীয় সরকার পরিকল্পিতভাবে আদমজী জুট মিলে বাঙালি অবাঙালি দাঙ্গা বাধিয়ে (এ দাঙ্গায় প্রায় পাঁচশত বাঙালি নিহত হয়) এর সব দায় দায়িত্ব যুক্তফ্রন্ট সরকারের ওপর চাপিয়ে দেয় এবং ১৯৫৪ সালের ৩০ মে ৯২ ধারা বলে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করে কেন্দ্রীয় শাসন জারি করে।

একই দিনে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা সচিব ইস্কান্দার মীর্জাকে পূর্ব বাংলার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই গভর্নর মীর্জা পূর্ব বাংলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। যুক্তফ্রন্টের হাজার হাজার নেতা কর্মীকে জেলখানায় ঢোকানো হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রায় তিন হাজার কর্মী ও তিপ্লান্ন জন এমএলএ গ্রেফতার হন। শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় করাগারে। ফজলুল হক হন গৃহবন্দী। এসময় মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দী বিদেশে অবস্থান করছিলেন। হিসেবে সে সময় পূর্ব বাংলায় কোন প্রতিবাদ সভা বা. বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়নি।

উল্লেখ্য যে, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর যুক্তফ্রন্ট সরকার ভাষা আন্দোলনের পক্ষে বেশ কিছু উদ্যোগ নেন। যেমন ২১ ফেব্রুয়ারিকে ছুটির দিন ঘোষণা, বর্ধমান হাউসকে বাংলা একাডেমিতে রূপান্তর প্রভৃতি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল কিন্তু পূর্ব বাংলায় ৯২ ক ধারা জারি ও ইস্কান্দার মীর্জার দমন নীতির কারণে তা ভেস্তে যায়। সরকার নতুন করে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত সকল কর্মতৎপরতা খর্ব করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত হয় এবং পরবর্তী বছর (১৯৫৫ সালে) যাতে ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত না হয় তার জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করে।

১৯৯৫ সালে সরকার ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি এবং সংগ্রাম পরিষদের বেশ ক’জন নেতাকে গ্রেফতার করা হলে ভাষা আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে। শেখ মুজিব ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বরে মুক্তিলাভ করার পর সাংগঠনিক কাজে ঢাকার বাইরে অবস্থান করছিলেন। ফলে ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপন প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এমন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও ছাত্রসমাজ ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপনের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে।

২০ ফেব্রুয়ারি রাতেই বাংলার বীর ছাত্রসমাজ সরকারী নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সকল ছাত্রাবাসে পতাকা উত্তোলন করে এবং রাত ১২টার পরপরই রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’ ধ্বনিতে ঢাকার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে। এ প্রসঙ্গে গাজীউল হক স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন,

“১৯৫৫ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে আমরা হাজতে। দেশে ৩খন স্বেচ্ছাচারী শাসন চলছে। কয়েক হাজার কর্মী জেলে আটক অথবা আত্মগোপন করে আছেন। এমতাবস্থায় ২১ শে ফেব্রুয়ারি যথাযথভাবে প্রতিপালিত হবে কিনা স্বভাবতই মনে প্রশ্ন ছিল। কিন্তু আমাদের এ ধরনের সন্দেহকে অমূলক ও ভ্রান্ত প্রমাণ করে দিয়ে ২০ শে ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে সমস্ত ঢাকা শহর স্লোগানে পর স্লোগানে গর্জে উঠলো। বাংলা ভাষার ঢাকার বুকে গণকণ্ঠের ঢল নেমেছিল ।

খ) ৬ দফার গুরুত্ব, আগরতলা মামলা

ইতিহাসঃ ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ রাজত্ব শেষে পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পূর্ব পাকিস্তান (পরে বাংলাদেশ) জনসংখ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল এবং পাকিস্তানের মোট রপ্তানি আয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ রপ্তানি (যেমন পাট) হতো পূর্ব পাকিস্তান থেকে। তবে, পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক সুবিধা আনুপাতিক ছিল না। বছরের পর বছর পূর্ব পাকিস্তান আঞ্চলিক ভিত্তিতে ক্রমাগত বৈষম্যের শিকার হওয়ায় গুরুতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। এর ফলে, অর্থনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা বৈষম্য সম্পর্কে প্রশ্ন বাড়াতে শুরু করে এবং ঐতিহাসিক ছয় দফা প্রদান করে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের একটি পরিসংখ্যান এখানে দেওয়া হলঃ

https://i.imgur.com/cUaZcHP.jpg

৬ দফার দাবিসমূহঃ

প্রস্তাব – ১ : শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি:

লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৌম হবে;

প্রস্তাব – ২ : কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা:

কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকারের ক্ষমতা কেবল মাত্র দু’টি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে- যথা, দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ।

প্রস্তাব – ৩ : মুদ্রা বা অর্থ-সম্বন্ধীয় ক্ষমতা:

মুদ্রার ব্যাপারে নিম্নলিখিত দু’টির যে কোন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা চলতে পারেঃ-(ক) সমগ্র দেশের জন্যে দু’টি পৃথক, অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে।অথবা(খ) বর্তমান নিয়মে সমগ্র দেশের জন্যে কেবল মাত্র একটি মুদ্রাই চালু থাকতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে শাসনতন্ত্রে এমন ফলপ্রসূ ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে করে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচারের পথ বন্ধ হয়। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভেরও পত্তন করতে হবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য পৃথক আর্থিক বা অর্থবিষয়ক নীতি প্রবর্তন করতে হবে।

প্রস্তাব – ৪ : রাজস্ব, কর, বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা:

ফেডারেশনের অঙ্গরাজ্যগুলির কর বা শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনরূপ কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। তবে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গ-রাষ্ট্রীয় রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে। অঙ্গরাষ্ট্রগুলির সবরকমের করের শতকরা একই হারে আদায়কৃত অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল গঠিত হবে।

প্রস্তাব – ৫ : বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা:

  • (ক) ফেডারেশনভুক্ত প্রতিটি রাজ্যের বহির্বাণিজ্যের পৃথক পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে।
  • (খ) বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাজ্যগুলির এখতিয়ারাধীন থাকবে।
  • (গ) কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মত কোন হারে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিই মিটাবে।
  • (ঘ) অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির মধ্যে দেশজ দ্রব্য চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা করজাতীয় কোন রকম বাধা-নিষেধ থাকবে না।
  • (ঙ) শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিকে বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং স্ব-স্বার্থে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।

প্রস্তাব – ৬ : আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা:

আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলিকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।

উপরোক্ত দফা গুলোতে আলোকপাত করলেই বোঝা যায় এটি কার্যত সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি কর্মসূচি। কিন্তু যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ২% উর্দু ভাষীর ভিত্তিতে অযৌক্তিক ভাষা সংস্কার করতে চেয়েছেন তিনি কি কখনো এই দাবী গুলো মানবেন।মানেনি,যার প্রেক্ষিতে আন্দোলন,কারাবরণ,অভ্যুথ্থান হতে থাকে।

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় লাভ করেন। তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায় তবুও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান পার্লামেন্টের ক্ষমতা রহিত করে তাদের বিজয়কে মেনে নেননি। আলোচনার নামে টালবাহানা করে সৈন্যসমাবেশ ঘটিয়ে ২৫ শে মার্চ রাতে ঘুমন্ত বাঙালির উপর ঝাপিয়ে পড়ে। ইতিহাসের বর্বরোচিত গণহত্যা অপারেশন সার্চলাইট ও বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারে অপারেশন বিগ বার্ড হান্ট চালায়। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা লিখিত আকারে দেন যা কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমান পাঠ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেন এবং পাকিস্তানী বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে হুকুম দেন।

এরপর বাংলাদেশের সরকার গঠিত হয় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল। আমাদের সরকার, ভূমি ও জনগণ সব ছিল শুধু সার্বভৌমত্ব পাকিস্তানের হাতে ছিল। সেটি পেতে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ হয়। বাংলাদেশ সরকার দেশের জনগণকে বহির্বিশ্বের সাহায্য নিয়ে সহযোগিতা,যুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরী ও তার সেনাবাহিনী এই যুদ্ধ করতে রসদ সামগ্রী সরবরাহ করেন । ভারত আমাদের প্রথম স্বীকৃতি দিয়ে আমাদের মুক্তিবাহিনী সাথে কোয়ালিশন গঠন করে যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়। আমরা সার্বভৌমত্ব পাই।

এতটুকু বলে দেয়ার কারণ হচ্ছে ছয়দফা দাবী না মানার কারণে বাঙালি জনগণ আর পাকিস্তানের শাসকে শাসনের চোখে না দেখে শোষণের চোখে দেখা শুরু করে। যার চুড়ান্ত রুপ ৭১ এ মানুষ দেখেছে। তাই ছয় দফাকে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ তথা অধিকার প্রতিষ্ঠার সনদ বলা। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক মুক্তি সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা আইয়ুব খান সরকারের পতন ঘটে এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কারণসমূহ আলােচনা করা হলো:

১. সামরিক শাসন

১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করে গণতান্ত্রিক পথ রুদ্ধ করেন। তিনি বিভিন্ন দেশের মাধ্যমে রাজনীতি ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন। PODO, FBDO-এর মাধ্যমে রাজনীতিবিদ ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কারারুদ্ধ করে সকল প্রকার আন্দোলন বন্ধ করার হুমকি দেয়। বাংলাভাষা, বাংলা বর্ণ, রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত ইত্যাদির উপর আঘাত হেনে বাংলাকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা করেন। পূর্ব বাংলার জনগণ এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ স্বরূপ আইয়ুব সরকারে বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, যা শেষ পর্যন্ত গণঅভুত্থানের রূপ নেয়।

২. মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা

১৯৫৯ সালে আইয়ুব খান পাকিস্তানে মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে সর্বজনীন ভােটাধিকারের পরিবর্তে মৌলিক গণতন্ত্রীদের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার বিধান করা হয়। এতে করে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটতাে না। এর ফলে মৌলিক গণতন্ত্রীদের ক্ষমতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং জনগণের সাথে সরকারের দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে। এমতাবস্থায় আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হয় এবং তাদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গণ অভ্যুত্থান ঘটায় ।

৩. সকল স্তরে বৈষম্যনীতি

আইয়ুব সরকারে উন্নয়ন দশকে দুই অঞ্চলের বৈষম্যনীতি স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের সময় রাজধানী ছিল করাচি। তার উন্নয়নের জন্য ব্যয় ধরা করা হয়েছিল ২০০ কোটি টাকা। আইয়ুব সরকার পাকিস্তানের রাজধানী স্থানান্তর করেন ইসলামাবাদে। তার উন্নয়নের জন্য ব্যয় হয়েছিল ২০ কোটি টাকা। আর পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী ঢাকার উন্নয়নের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছির ২ কোটি টাকা। এছাড়া শিক্ষা, কৃষি, চিকিৎসা, শিল্প গবেষণা, চাকরিসহ সবক্ষেত্রে দুই পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য ছিল চোখে পড়ার মতাে। যেমন-চাকরিতে নিয়ােগের ক্ষেত্রে উভয় অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য ছিল পাহাড়সম ।

৪. পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি ঔদাসীন্যতা

১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের সীমানায় সৈন্য মােতায়েন করা হলেও পূর্ব পাকিস্তানের সীমানা অরক্ষিত থাকে। ফলে এ অঞ্চলের জনগণ নিরাপত্তার অভাববােধ করে এবং আলাদা সৈন্য বাহিনী গঠনের প্রস্তাব করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি সরকার ক্ষমতা সংকুচিত হওয়ার ভয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের এ দাবি উপেক্ষা করে। এতে করে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের জনমনে হতাশা ও ক্ষোভের সঞ্চার করে। যা শেষ পর্যন্ত গণঅভুথানের রূপ নেয়।

৫. আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা

১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগড়তলায় বাংলাদেশের আলী রেজা ও ভারতীয় ইন্টার ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের ব্রিগেডিয়ার মেনন এক বৈঠকে মিলিত হন। জানাজানি হলে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামী করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করা হয়, যা আগড়তলা মামলা নামে পরিচিত। এ মামলা দায়ের পর পূর্ব বাংলার জনগণ আইয়ুব সরকারে বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আইয়ুব খানের লেলিয়ে দেওয়া পেটুয়া বাহিনী এ বিক্ষোভ দমন করতে ব্যর্থ হয়। সুতরাং আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলাও ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের একটি অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত।

৬. ছাত্রনেতা, আসামি ও শিক্ষকের মৃত্যু

১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের নেতা আসাদুজ্জামান পুলিশের গুলিতে নিহত হয় । ১৫ ফেব্রুয়ারি আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে ক্যান্টনমেন্টে হত্যা করা হয়। অতঃপর ১৮ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনীর সদস্যরা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহাকে হত্যা করে। আর এসব অন্যায় হত্যাকাণ্ডের উত্তাপ সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে।

৬৯ এর গনঅভ্যুত্থানের ফলাফলঃ

১. আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ফলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অবসান ঘটে। গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতাগণ ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রতিবাদে অনড় ও অটল থাকায় ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত সব আসামিকে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে আইয়ুব সরকার বাধ্য হন।

২. রাজবন্দিদের মুক্তি

১৯৬৯ সালে গণআন্দোলন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে বিশেষ করে বাঙালি জনগণের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সঞ্চার হয়। তারা তাদের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। প্রচণ্ড গণআন্দোলনের মুখে পূর্ব বাংলার সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দিদের বিনা শর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ।

৩. শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধু উপাধি লাভ

১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের অন্যতম প্রভাব পড়ে শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনে। এ আন্দোলনের ফলেই তিনি বাংলার জনগণের কাছে অত্যন্ত প্রিয় পাত্র হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৮) রমনার রেসকোর্স ময়দানে এক গণসম্বর্ধনায় শেখ মুজিবুর রহমানকে তৎকালীন ছাত্র নেতা তােফায়েল আহমেদ বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

৪. গােল টেবিল বৈঠকের আহ্বান

১৯৬৯ সালের গণঅভুথানের তীব্রতা প্রশমনের জন্য পাকিস্তানের সামরিক শাসন আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাওয়ালপিণ্ডিতে এক গােল টেবিল বৈঠক আহবান করেন। এ বৈঠকে ৬ দফা কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করা হয়। ফলে গণআন্দোলন আবারও তীব্ররূপ ধারণ করে এবং প্রশাসন নিশ্চল হয়ে পড়ে।

৫. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি

গণ-অভ্যুত্থানে প্রশাসন নিশ্চল হয়ে পড়লে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম ও অবনতি ঘটে। ফলে ২০ মার্চ আইয়ুব খানের সভাপতিত্বে রাওয়ালপিণ্ডিতে পুনরায় গােল টেবিল বৈঠক বসলে সেখানে তিনটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

  • ক. প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে।
  • খ. যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন পদ্ধতি প্রবর্তন করা হবে।
  • গ. সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে।

৬. গােল টেবিল বৈঠক বর্জন

আইয়ুব কর্তৃক আয়ােজিত গােল টেবিল বৈঠকে গৃহীত তিনটি বিষয়ে আইয়ুব খান ও বিরােধীদলীয় নেতৃবৃন্দ একমত হয়। কিন্তু ৬ দফার ভিত্তিতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে না নিলে আওয়ামী লীগ গােল টেবিল বৈঠক বর্জন করে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। এ সময় মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেন। এতে আইনশৃঙ্খলার আরাে অবনতি ঘটতে থাকে।

৭. আইয়ুব সরকারের অবসান

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের তীব্রতা বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি সামাল দিতে স্বৈরাচারী আইয়ুবখান ইয়াহিয়ার নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

৮. ১৯৭০ সালের নির্বাচন

এ কারণে ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে স্বাধিকার চেতনায় জাগ্রত করে তােলে। এ কারণে, পূর্ব পাকিস্তানে ঘােলাটে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে অবনতির দিকে যেতে থাকে। তাই শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালে নির্বাচনের ঘােষণা দেন।

৯. জাতীয়তাবােধ সৃষ্টি

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবােধের পুনর্জাগরণ ঘটে। আর জাতীয়তাবােধ চেতনা থেকে তাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণে উৎসাহ বেড়ে যায়।

১০. ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন

১৯৬৯ এর গণআন্দোলনের সাথে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। কার্যত ১৯৬৬ সালের ৬ দফার মাধ্যমে যে স্বাধিকার আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৯৬৯ সালে তা একধাপ এগিয়ে নেয়া হয় এবং ১৯৬৯ এর গণআন্দোলনের শেষ পরিণতি ঘটে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাধ্যমে।

পরিশেষে বলা যায় যে, বাঙালির ইতিহাসে ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের ফলাফল তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ফলে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক শােষণ ও বঞ্চন থেকে বাঙালি জাতির মুক্তির পথ রচিত হয়। এ আন্দোলনকে আইয়ুব সরকার দমন করতে চেয়েছিল কিন্তু ততদিনে সরকারের ভীত নড়বড়ে হয়ে যায়। তীব্র আন্দোলনের মুখে অবশেষে পাকিস্তানের লৌহমানব খ্যাত আইয়ুব খানের পতন ঘটে। এ আন্দোলনের মাধ্যমেই পূর্ব বাংলার জনগণ নিজেদের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সংগ্রাম করে এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে অভ্যুদয় ঘটায় যার সবই ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের ফলাফল।

ঘ) ৭০ এর নির্বাচন

১৯৭০ সালের নির্বাচনের পটভূমি 

পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর বিমাতাসুলভ আচরণ আর নির্যাতিত-লাঞ্ছিত পূর্ব বাংলার জনগণের খণ্ড খণ্ড প্রতিবাদ ও ঘটনা ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পটভূমি রচনা করে। নিচে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পটভূমি আলােচনা করা হলাে-

১. ভাষা আন্দোলন

সমগ্র পাকিস্তানের ৫৬% এরও বেশি লােকের মুখের ভাষা ছিল বাংলা। আর উর্দু ভাষাভাষির সংখ্যা ছিল মাত্র ৬%। এতদসত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তান শাসকমহল উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্ট করে। যার প্রেক্ষিতে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয় এবং বাংলার অসংখ্য তরুণ প্রাণ দেয়। এ ভাষা আন্দোলনের শিক্ষা থেকেও পাকিস্তানে একটি সাধারণ নির্বাচনের প্রয়ােজনীয়তা অনুভূত হয়। যার অবসান ঘটে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে ।

২. যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন

প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভােটাধিকার ও স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলী এই দুই নীতির ভিত্তিতে ১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে ৪ দলের সমন্বয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্ট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং মুসলিম লীগের শােচনীয় পরাজয় ঘটে। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করলেও পাকিস্তান শাসকবর্গ চক্রান্ত করে তা ভেঙে দেয়। এহেন প্রেক্ষাপট বাঙালির মনে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে দেয়, যা ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পথকে প্রশস্ত করে।

৩. সংবিধান প্রণয়নে ব্যর্থতা

ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টির পর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা সংবিধান রচনা করার কথা থাকলেও শাসকবর্গের অনীহার কারণে ১৯৫৬ সালের আগে তা প্রণয়ন করা সম্ভব হয় নি। যার দরুন জনগণ একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের উপায় খুঁজতে থাকে। যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে।

৪. ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন

১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা এবং ২৭ অক্টোবর পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করে। সামরিক শাসন জারি করে আইয়ুব খান সংবিধান ও সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন। এতে জনগণের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হওয়ায় জনগণ সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয় ও বেসামরিক সরকারের শাসন কামনা করে, যার ভাবনা থেকে হয় ১৯৭০ সালের নির্বাচন।

৫. ছয় দফা আন্দোলন

পশ্চিম পাকিস্তান সামরিক শাসকদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক শােষণ ও নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব ছয় দফা কর্মসূচি ঘােষণা করেন। এ কর্মসূচিকে আইয়ুব খান বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ধ্বংসাত্মক হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আইয়ুবের এ ঘােষণায় বাঙালি জনগােষ্ঠী বিন্দুমাত্র পিছু না হটে উল্টো আন্দোলনের অগ্নি প্রজ্বলন করে। ফলে বেসামরিক শাসকের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর তীব্র হতে থাকে। যার প্রতিফলন ঘটে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে ।

৬. আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা

বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা বা ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনের মাধ্যমে একটি পরিপূর্ণ রূপ লাভ করতে যাচ্ছিল তা নস্যাৎ করার জন্য স্বৈরশাসক আইয়ুব খান অত্যাচার ও নিপীড়নের পথ বেছে নেন। এর অংশ হিসেবে ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও প্রহসনমূলক ‘আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা, দায়ের করা হয় ও তাকে কারাগারে বন্দি করা হয়। ফলে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সমগ্র বাংলায় তীব্র প্রতিবাদ এবং নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকারের দাবি জোরালাে হতে থাকে। এ প্রতিবাদই ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পথকে সুগম করে।

৭. আইয়ুব খানের পতন

আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের এবং শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে ১৯৬৯ সালে সমগ্র পাকিস্তানে আইয়ুব বিরােধী গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়। আইয়ুব সরকার পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে নির্যাতন ও দমনপীড়নের পথ বেছে নেন। ফলে জনগণের ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালার মতাে কাজ করে। এর প্রেক্ষিতে ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের পতন ঘটে এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রক্রিয়া আরাে এক ধাপ এগিয়ে যায়।

৮. রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার

আইয়ুব খানের পতনের পর পাকিস্তানের ক্ষমতার দৃশ্যপটে আসেন সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনালের আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। একই তারিখে তিনি ক্ষমতায় আরােহণ করেন এবং সমগ্র পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন। অতঃপর ১ জানুয়ারি ১৯৭০ সালে তিনি আইয়ুব খানের জারি করা রাজনৈতিক কর্মকান্ডের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। ফলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হয়।

৯. আইনগত কাঠামো আদেশ জারি

নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ ‘আইনগত কাঠামাে আদেশ জারি করেন। এ আদেশে পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদগুলাের গঠন কাঠামাে, জনপ্রতিনিধির সংখ্যা ও কাজ করার রীতি নির্দেশিত হয়, যা প্রকারান্তরে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।

১০. নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা

ইয়াহিয়া খানের ১৯৬৯ সালের ২৮ নভেম্বর ঘােষণার প্রেক্ষিতে ১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর জাতীয় পরিষদে এবং ২২ অক্টোবর জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ঘােষণা করা হয়। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবল বন্যার কারণে নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে ৭ ডিসেম্বর ও ১৭ ডিসেম্বর যথাক্রমে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের তারিখ ঘােষিত হয় । ঘােষিত তারিখ অনুযায়ী এক ব্যক্তি এক ভােট’ নীতির পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হলেও ১২ নভেম্বর পূর্ব বাংলায় ভয়াবহ জলােচ্ছাস হলে উভয় পরিষদের ২৬টি আসনে নির্বাচন স্থগিত করা হয়, যা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি।

পরিশেষে বলা যায় যে, পূর্ব বাংলার জনগণের উপর পর্বতসম নির্যাতন শোষণ ও বঞ্চনার প্রেক্ষিতে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের পতন ও ইয়াহিয়ার ক্ষমতায় আরোহণের প্রেক্ষিতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রেক্ষাপট রহিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে মােট ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদে মােট ২৯৮টি আসন পেয়ে বিপুল ভােটে জয়লাভ করে, যা ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ে সহায়তা করে

১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল 

১৯৭০ সালের সমগ্র পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

ক. জাতীয় পরিষদ

সমগ্র পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের আসন সংখ্যা ছিল মােট ৩১৩টি। এর মধ্যে সাধারণ ৩০০টি এবং ১৩টি সংরক্ষিত মহিলা আসন ছিল। ৩১৩টি আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ছিল ১৬৯টি (সংরক্ষিত ৭টি এবং সাধারণ ১৬২টি)। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ছিল ১৪৪টি (সংরক্ষিত ৬টি এবং সাধারণ ১৩৮টি)। নির্বাচনী ফলাফলে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ১৬২টি সাধারণ আসনের মধ্যে ১৬০টি এবং ৭টি সংরক্ষিত আসনের সবকটিসহ মােট ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে। অবশিষ্ট ২টি আসনের একটি পায় পিডিপি প্রধান নুরুল আমিন এবং অন্যটি পায় চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় চৌধুরী। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাকিস্তান পিপলস পার্টি ১৩৮টি সাধারণ আসনের মধ্যে ৮৩টি এবং সংরক্ষিত ৬টি আসনের মধ্যে ৫টিসহ মােট আসন পায় ৮৮টি। বাকি সংরক্ষিত ১টি আসন পায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালী)।

নিচে জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের ফলাফল হকে দেখানাে হলাে-

https://i.imgur.com/kgVvunq.jpg

উপরিউক্ত ছক হতে দেখা যায় যে, আওয়ামী লীগ সংরক্ষিত ৭টি আসনের সবকটি এবং সাধারণ আসনের ১৬২টির মধ্যে ১৬০টিসহ মােট ১৬৭টি আসন পায়। অন্যদিকে পিপিপি ১৩৮টি সাধারণ আসনের মধ্যে ৮৩টি (পাঞ্জাব ৬৪, সিন্ধু ১৮, উত্তর- পশ্চিম সীমান্ত ১ এবং বেলুচিস্তান ০) এবং সংরক্ষিত ৬টি আসনের মধ্যে ৫টি সহ মােট ৮৮টি আসন পায়।

খ. প্রাদেশিক পরিষদ

সমগ্র পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের মােট আসন সংখ্যা ছিল ৬২১টি। নির্বাচনী ফলাফলে দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ৩০০টি সাধারণ আসনের মধ্যে ২৮৮টি এবং সংরক্ষিত ১০টি আসনের সবকটিসহ মােট ২৯৮টি আসনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে পিপিপির চরম ভরাডুবি ঘটে।

প্রাদেশিক নির্বাচনের ফলাফল সম্পাদনা

প্রাদেশিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান এ্যাসেম্বলীর ৩০০টি আসনের ২৮৮টি জিতে নেয়। পশ্চিম পাকিস্তানের অপর চারটি এ্যাসেম্বলীতে তারা কোন আসন পায়নি। পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের এ্যাসেম্বলীতে পাকিস্তান পিপলস পার্টি ভালো করে কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে কোন আসনে জয় পায়নি। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্তানে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালি) এবং পিএমএল (কাইয়ুম) ভালো করে।

https://i.imgur.com/zr68O8P.jpg

 

আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়সম্পাদনা

১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ উভয় ক্ষেত্রে নির্বাচন করে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করে। এ নির্বাচন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আসন প্রাপ্তির ছক চিত্ররূপঃ

https://i.imgur.com/0Y661aK.jpg

https://i.imgur.com/ungQSPC.jpg

I hope you are enjoying this article. Thanks for visiting this website.